রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন করে পুকুর খনন করা হচ্ছে। গত দুই বছরে অবৈধভাবে ২৪৫টি পুকুর খনন করা হয়েছে। এতে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে । পাশাপাশি পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
পুকুর খনন থামাতে প্রশাসন অভিযান ও জরিমানাতেই আটকে রয়েছে । জরিমানা পরিশোধের পর ফের খনন করা হচ্ছে পুকুর। বিষয়টা এমন – ইউএনও ও এসিল্যান্ড কে ? আবার কোন কোন পুকুর ব্যবসায়ী তো সরাসরি বলেই ফেলছেন – এই পুকুর রাজশাহী জেলা প্রশাসক সাহেবের অনুমতি নিয়েই কাটা হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ গনমাধ্যমকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন – কেউ যদি আমার নাম করে পুকুর খনন করার কথা বলে থাকেন তবে সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করুন। এক্ষেত্রে কাউকে কোন ছাড় দেয়া হবেনা।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যমতে, ২ বছর আগে গোদাগাড়ী উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৮ টি। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৮৩টিতে। অর্থাৎ দুই বছরে ২৪৫টি পুকুর খনন করা হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকদের দাবি, এ সময়ের মধ্যে ৩ শতাধিক পুকুর খনন করা হয়েছে। খনন বন্ধে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১১ বার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ১১টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জনকে জরিমানা ও ১ জনকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে নতুন ২৪৫টি পুকুর কিভাবে অনুমতি পেল ? এর উত্তর না গনমাধ্যমের কাছে না আছে জেলা প্রশাসনের কাছে।
কিন্তু গেল শনিবার ( ২০/০৪/২০২৪ইং ) সরেজমিন গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাট পৌরসভার চব্বিশনগরের ফুলতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৩টি স্কেভেটর (পুকুরখনন যন্ত্র) দেদারসে মাটি কেটে পুকুর খনন চলছে । সেই সাথে পুকুর খননের মাটি নেয়া হচ্ছে ৭থেকে ৮ টি ড্যাম ট্রাকে । প্রায় ৮ মিনিটে একটি ট্রাক্টরে মাটি ভর্তি করা হচ্ছে। আর এই মাটি বিক্রি হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন ইটভাটায় । আরোও জানা যায়, পুকুরের মাটি বিক্রি হয় ২ শ্রেনীতে। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক্টর মাটি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় এবং প্রতি ট্রাক মাটি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। এদিকে পুকুর খননের আদিবাসী ২০টি পরিবার পড়েছেন চরম দূর্ভোগে। তারা একের পর এক অভিযোগ জানিয়ে পাচ্ছেননা কোন সুফল।
তবে পুকুর খননের বিষয়ে পুকুর খননকারী বিষুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান – গোদাগাড়ী উপজেলা প্রশাসনের আমার কোন অনুমতি পত্র নেই। স্থানীয়দের ম্যানেজ করে পুকুর খনন করছি।
অন্যদিকে রাজশাহী চাপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে আলিমগঞ্জ এলাকায় ন্যাশনাল পেট্রোল পাম্পের পাশে এমবিএন ইট ভাটার পেছনে ফসলী জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে সিয়াম ইট ভাটায়। নিয়ম করে সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে একটি প্রভাবশালী মহল কৃষকদের ফসলী জমির মাটি কেটেই চলেছে।
মোহনপুরেও চলছে পুকুর খনন ও মাটি কাটার উৎসব
মোহনপুরে মর্গার বিলই চলছে সংস্করের নামে চলছে পুকুর খনন এতে ধানি জমি ও রাস্তা ঘাট নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন এই পুকুরগুলো খননের পেছনে আছে স্থানীয় বাবলু নামের এক ব্যাক্তি এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
তবে উল্লেখ্য যে, পুকুর খনন ও মাটি কাটা ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা বেছে নিয়েছেন অভিনব কৌশল। যে কৌশলের কাছে বোকা হয়ে যেতে হবে যে কোন কাউকেই।
▶️ যেভাবে অবৈধ উপায়ে পুকুর খননের পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হয়
কেস ষ্টাডি ১ – রাজশাহী গোদাগাড়ীর পুকুর ব্যবসায়ী হাবিব জানান – প্রশাসন কখনই সরাসরি পুকুর খননের অনুমতি দেয়না সেহেতু আমরা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করি। পুকুর খননের আগে উক্ত খননের জায়গায় কিছুটা মাটি কেটে গর্ত তৈরি করি। এরপর সেখানে ৫/১০ বাড়ির ময়লা পানি জমা করে একটি ডোবা বা নালা তৈরি করে রেখে দেই। এরপর ডোবা বা নালা তৈরি হওয়ার পর জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের কাছে সেটিকে ছোট পুকুর অভিহিত করে সংস্কার করার দরখাস্ত করি। এরপর প্রশাসন সরেজমিন তদন্ত করতে আসলে আশেপাশের বাড়ির মানুষ ও নিজস্ব কিছু লোকদের ম্যানেজ করে প্রমান করাতে সক্ষম হই এটি একটি ছোট পুকুর। এরপর কোন সমস্যা ছাড়াই সেটি সংস্কারের অনুমতি পাওয়া মাত্র ১০ বিঘা হোক আর ২০ বিঘা তখন ইচ্ছেমত পুকুর খনন করি।
▶️ যেভাবে ফসলী জমির মাটি বৈধ উপায়ে কেটে বিক্রি করা হয়
কেস ষ্টাডি ২ – অসমতল জমি সমতল করা অনুমতি দেয় জেলা বা উপজেলা প্রশাসন। যা ভূমি আইনেও রয়েছে। সেই আলোকে ভালো ফসলী জমির মাটি বিক্রি করার পূর্বে ট্রাকটর চালিয়ে উঁচু নিচু করে অসমতল করা হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পুরাতন ইটের বুজুরিও ফেলা হয় । এরপর উক্ত জমির কৃষকের মাধ্যমে এসিল্যান্ড বরাবর জমি সমতল করার জন্যে আবেদন করা হলে জমি সমতল করার অনুমতি দেয়া মাত্রই শুরু হয় মাটি বিক্রির মহোৎসব।
তবে সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাহিদ হাসান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন – গেল কয়েক মাসে পুকুর খননের বিষয়গুলো জানা মাত্রই সেখানে অভিযান চালিয়েছি। রাতের আঁধারেও অনেকেই পুকুর খননের চেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু আমি সরেজমিন অভিযান চালিয়ে সেগুলোও বন্ধ করে দিয়েছি । ভ্রাম্যমান আদালতও পরিচালনা করছি। তবে আমি গোদাগাড়ীতে থাকা অবস্থায় কৃষি জমিতে কোনো ধরনের পুকুর খনন কিংবা ফসলী জমির মাটি বিক্রি করতে দেবো না।
▶️ যা বলছেন অভিজ্ঞমহল
তবে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল বলছেন – এসব পুকুর খনন করতে কৃষি বিভাগ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়নি। যদিও কৃষিজমি সুরক্ষা আইন-২০১৬ (খসড়া)-এর ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনোভাবেই কৃষিজমির ব্যবহার ভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। আর ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ আইনে কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে ইট তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মন্তব্য