আবদুর রাজ্জাক, কক্সবাজার।। কক্সবাজারের রামু গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের অঘোষিত সম্রাট নিষিদ্ধ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর এমপি কমলের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান যুবলীগ নেতা সীমান্তের শীর্ষ চোরাকারবারী ও সন্ত্রাসী শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীনের ডেরায় অভিযান চালিয়েছে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।তিনি জানিয়েছেন, রোববার ভোর ৪টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর একটি টিম রামুর মাঝিরকাটা এলাকায় শাহীন ডাকাতের ডেরায় অভিযান চালায়।ওই সময় ডাকাত শাহীনের নবনির্মিত বাড়ি থেকে ১৯ রাউন্ড বিভিন্ন রকমের রাইফেল-এর গুলি, ১টি টাকা গননার মেশিন, ২টি দা, ১টি ল্যাপটপ, ৪টি আইপি ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে অভিযানের আগাম খবর পেয়ে ডাকাত শাহীন পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি ।
পুলিশের তথ্য সূত্র বলছে, সি,আর ও জি,আর মামলা এবং জিডিসহ প্রায় ১৭ মামলার পলাতক আসামি ডাকাত শাহীন। তার দুই ডজন মামলার মধ্যে ৯টি ডাকাতি, ডাকাতি প্রস্তুতি ও ছিনতাই, ৪টি হত্যা মামলা, দুটি অস্ত্র মামলা, দুটি মাদক মামলা এবং বাকিগুলো বিভিন্ন থানায় জিডি হিসেবে রয়েছে।
স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখণ্ড, যেখানে আইন, প্রশাসন, সরকার সব কিছুই ডাকাত শাহীন—
হিন্দি মুভি শোলে সিনেমাটিতে গাব্বার সিং এর একটা ডায়ালগ বেশ জনপ্রিয়তা পায়,বেটা শো যা ন্যাহি তো গাব্বার আ যা য়ে গা! যার বাংলা অর্থ, বাবু ঘুমিয়ে পর নয়ত গাব্বার চলে আসবে।
বাস্তব জীবনে গাব্বার না আসলেও বিগত দেড় দশক ধরে কক্সবাজারের রামুতে গাব্বার সিং এর চেয়েও নিষ্ঠুর মনুষ্যত্বহীন মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। যার ভয় দেখিয়ে, নাম শুনিয়ে এলাকার বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হয়। এতক্ষণ এত উপমা যাকে নিয়ে তিনি বহু মামলার আসামী শীর্ষ ডাকাত শাহীনুর রহমান ওরফে শাহীন ডাকাত। তিনি রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের মাঝিরকাটার গ্রামের মোঃ ইসলামের পুত্র।
তার মায়াবী চেহারা ও সুদর্শন শারীরিক গঠন দেখলে যে কেউ সহজে তার প্রতি বিমোহিত হবে। কিন্তু তার এই সুন্দর অবয়বে লুকিয়ে আছে নৃশংস এবং ভয়ঙ্কর এক দানবীয় চরিত্র। মানুষ তাকে নব্য এরশাদ সিকদার বলেও তুলনা করে।
রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকা বিশেষ করে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড় ও বাইশারীর দেড় লক্ষাধিক মানুষ তার কাছে জিম্মি। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে অপ্রতিরোধ্যভাবে চলছে তার রাম রাজত্ব। তিনিই ঐ এলাকার স্বঘোষিত শাসক। টু-শব্দ করার সাহস কারো নাই। মতের বাইরে গেলেই ধরে নিয়ে গিয়ে দেয়া হয় কঠিন শাস্তি। প্রায়শঃই প্রকাশ্যে ভারী অস্ত্র উঁচিয়ে ফিল্মি স্টাইলে এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নিজের অবস্থান জানান দেন ডাকাত শাহীন। প্রশাসনের শাসন চলে না এ অঞ্চলে। শাহিনের শাসনে চলে পুরো এলাকা, তার লাইফস্টাইল যেন তামিল সিনেমার বাস্তব কাহিনী। বলা চলে শাহিনের হাতে স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখন্ড, যেখানে আইন, প্রশাসন, সরকার সব কিছুই ডাকাত শাহীন।
থানা সূত্রে জানা যায়, ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক, হত্যা, চোরাচালান সহ মোট ২০ টির অধিক মামলা রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, রামু-কক্সবাজার এবং নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার বিপদগামী যুবক, সাজাপ্রাপ্ত এবং দাগী আসামীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে শাহীন বাহিনী। পাহাড়ে রয়েছে ডাকাত শাহীনের বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডার। সেখানে দেয়া হয় তার বাহিনীর কয়েক শত সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, রয়েছে টর্চার রুম, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধরে নিয়ে গিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়।
স্থানীয় তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঈদগড়ের ভয়ংকর ডাকাত কালু, কলিমুল্লাহসহ কয়েকজনের হাত ধরে ধরে শাহীনের অপরাধ জগতের সূত্রপাত। শুরুতে ঈদগড়- ঈদগাঁও সড়কে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে যায় শাহীন। পরে জেল থেকে বের হয়ে ২০১২ সালের দিকে নিজেই একটি বাহিনী গঠন করে রামুর ঈদগড়, গর্জনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ির রাবার বাগান মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেন। জোরপূর্বক চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো: হারুনের রাবার বাগান সহ একাধিক মালিকের রাবার বাগান দখল করে নিয়েছে এই গ্রুপটি। পরবর্তী সময়ে বাড়তে থাকে তার অপরাধনামা। প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, দখলবাজি, লুটতরাজ, এমন কিছু বাকি নেই যা তার নিজস্ব ডাকাত বাহিনী দ্বারা সংগঠিত হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালের দিকে স্থানীয় সাংসদ ও হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের সংস্পর্শে আসেন শাহীন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধ জগতে নিজের শক্ত অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। নিজেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেন। যার ফলশ্রুতিতে সাংসদ কমল ডাকাত শাহীনের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের সুবিধা নিতেন। এদিকে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর শাহীন আরো বেশি বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারে সংঘাত শুরু হলে সীমান্ত দিয়ে এপারে অবৈধভাবে গরু প্রবেশ শুরু হলে চোরাচালান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ শাহীনের হাতে চলে যায়। এরপর থেকে সীমান্তে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সাথে নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হত শাহীন ও তার গ্রুপের। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান তথা রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে চলে গেলে ডাকাত শাহীন আরাকান আর্মির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তারা সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে চোরাচালান ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে শাহিনকেই বেছে নেন। যেহেতু শাহীনের বিশাল বাহিনী এবং অস্ত্র ভান্ডার রয়েছে, সেহেতু শাহিনের প্রতিই খুবিই আস্থাশীল আরাকান আর্মি। বর্তমানে শাহিনের মাধ্যমেই আরাকান আর্মি সীমান্তের এপারে অবর্ননীয় চোরাচালান করছে। এসব চোরাচালানের মধ্যে গরু-মহিষ,তার সাথে ভারি অস্ত্র, ইয়াবা,আইস, স্বর্ণের বার, সিগারেট, সুপারী উল্লেখযোগ্য। একই সাথে ডাকাত শাহিন এপার থেকে আরাকান আর্মির যাবতীয় রসদ যোগান দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা জানান, শাহীনের চোরাচালানে কেউ বাধা হয়ে দাড়ালে নিশ্চিত মৃত্যু, চোরাচালানকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক মাসে দশটির মতো হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে ডাকাত শাহীন। শাহীনের হাতে খুনের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে সর্বদা, জনসম্মুখে করা খুনের তথ্য মানুষ জানলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান থেকে যাচ্ছে আড়ালে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী এমনকি পেটের অনাগত সন্তানও রেহায় পায়নি শাহীনের হাত থেকে।
সূত্র বলছে, চোরাচালান থেকে শাহীনের প্রতিদিনের আয় আনুমানিক ৫০ লক্ষ টাকার অধিক, যার অধিকাংশই তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে বিলি বন্টন করেন। এ কারণে প্রশাসন তার প্রতি এত উদাসীন ও নমনীয়তার মূল কারণ বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির সাংবাদিকরাও ডাকাত শাহীনের ভয়ে তটস্থ, নিরাপত্তার কারনে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ করতে ভয় করে তার বিরুদ্ধে। কোন সাংবাদিক তার অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে পরের দিন তার এবং তার পরিবারের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। এমনকি মিথ্যা মামলায় আসামী হয়ে ফেরারী জীবন কাটাতে হচ্ছে অনেক সাংবাদিকে। একটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের সুত্র ধরে স্থানীয় দুই সাংবাদিক হাফিজুল ইসলাম ও সরওয়ার জাহানকে মিথ্যা মামলার আসামী হতে হয়েছে। এদিকে দৈনিক কক্সবাজার ৭১ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে নিউজ প্রকাশ করায় দৈনিক কক্সবাজার ৭১ এর বার্তা সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে বুলেটিন টিভি নামক একটি ভূয়া পেইজ থেকে বিভিন্ন রকম মিথ্যা ও ভূয়া অপ প্রচার চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন রকম হুমকি ধমকি প্রদান করেন ডাকাত শাহীনের কক্সবাজারে নিয়োজিত কিছু সংবাদকর্মী।
শাহীনের চলমান মামলার সংখ্যা অসংখ্য। অথচ তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের সদ্য নির্মিত আলিশান ভবনে অবস্থান করছে, প্রতিদিন চোরাকারবারের মাফিয়াদের সাথে বৈঠকে বসছেন। দলবল সহকারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হচ্ছেন, মঞ্চে বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তাকে ধরার সাহস করছে না। গত ৭ এপ্রিল গর্জনিয়া ইসলামীয়া আলিম মাদ্রাসার দাখিল পরিক্ষার্থী বিদায়ী অনুষ্ঠানে ও ৮ এপ্রিল গর্জনিয়া মাঝিরকাটা কিন্ডারগার্টেন দাখিল মাদ্রাসার বিদায়ী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। উক্ত বক্তব্য বিজ্ঞাপন আকারে অনলাইনেও প্রচার করা হয়েছে। মূলত আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে বোঝাপড়া রয়েছে বলেই শাহীন দ্বিধাহীনভাবে তার কর্তৃত্ব কায়েম করতে সক্ষম হচ্ছে।
ডাকাত শাহীনের ভয়ে প্রাণ সংশয়ে আত্মগোপনে থাকা সাংবাদিক সরওয়ার জাহান জানান, সীমান্তের এপারে আরাকান আর্মির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি জানান, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন হুমকি, তেমনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও চরম বিপজ্জনক। এমতাবস্থায় আরাকান আর্মি নিজেদের যাবতীয় রসদের সম্পূর্নরুপে বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল। আর এই রসদের একমাত্র জোগানদাতা ডাকাত শাহীন। তার রসদ না পৌঁছালে আরাকান আর্মি অনেকটা না খেয়ে মরবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি বিশেষ করে অকটেন যাচ্ছে ড্রামে ড্রামে। আরাকান আর্মি এসব অকটেন বিভিন্ন অস্ত্র ও বোমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এপার থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বিবিধ পন্য ওপারে যাচ্ছে। সেই সাথে ওখান থেকে এপারে ঢুকছে গরুর সাথে ইয়াবা,আইস, স্বর্ণ,সুপারি ও সিগারেট।
আরেক সাংবাদিক আক্ষেপ করে জানান, মৃত্যু ভয় সকলের আছে, এত অভিযোগ এত মামলা থাকার পরও যেখানে প্রশাসন শাহীনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এমন একটি প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকরা তার বিরুদ্ধে কলম ধরতে ভীত-শঙ্কিত।
শাহীনের অপরাধনামা:
৩ মার্চ ২০২৩ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি ইরফান (১৮) কে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতের পিতা শফিউল্লাহ পুতু’র দাবি প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য শাহীন তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
১৬ ই মার্চ ২০২৪ সালে বৃহস্পতিবার থিমছড়ি আহমদুর রহমানের ছেলে আবু তালেব(৩৭) হত্যা করে শাহিী ডাকাত। গরু পাচারে বাধাদান করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২২ এপ্রিল ২০২৪ সালে সময় স্থানীয় লোকজনের ফসল নষ্ট করে গরু চোরাচালান করছিল শাহীন, এতে বাধাদান করায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাহিন ও তার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলি ও এলোপাতাড়ি দায়ের কোপে গর্জনিয়ার থোয়াইংগাকাটা ঘোনারপাড়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে জাফর আলম (৫৫) ও তার ছেলে মোহাম্মদ সেলিম (৩৩) বাবা-ছেলেকে হত্যা করা হয়।
৮ মে ২০২৪ সালে রামু উপজেলার পাহাড়ি জনপদ গর্জনিয়ায় আবুল কাশেম (৪০) নামে এক মোটরসাইকেল ড্রাইভারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবারের দাবী নিহত আবুল কাসেমকে শাহীনের নির্দেশে রাত ২টার দিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পাশের নারাইম্মাঝিরি পাহাড়ে গুলি করা হয়। আবুল কাসেমকে খুন করে তার প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এই হত্যাকাণ্ড বলে জানান নিহতের পরিবার।
৩ জুন ২৪ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী রামুতে বিজিবির মাদক ও চোরাচালানবিরোধী টহল দলের ওপর গুলি চালায় চোরাকারবারিরা। এ ঘটনায় আত্মরক্ষার্থে বিজিবির পাল্টা গুলিতে শাহীন ডাকাতের সেকেন্ড ইন কমান্ডার নেজাম উদ্দিন নামে এক ডাকাত আহত হয়। পরে আহত নেজামকে হাসপাতালে না নিয়ে শাহিনের ঘরের বারান্দায় ফেলে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করে ডাকাত শাহীন। মূলত নেজাম উদ্দীন হত্যায় প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতেই শাহিনের এমন চালাকি। পরে নেজামের বাবাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে বিজিবি, সাংবাদিক এবং নিরীহ লোকজনকে আসামী করে মামলা করান।
ডাকাত শাহীনের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলায় গর্জনিয়ার ইউপি সদস্য মনিরুলকে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে হাতুড়ি দিয়ে পিঠিয়ে তার দুই পা ভেঙ্গে দেয়া হয়।
চাঁদার দিতে অস্বীকৃতি জানায় গর্জনিয়ার হেলাল উদ্দিনকে গভীর রাতে অস্ত্রের মুখে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তার টর্চার সেলে আটকে রেখে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন চালায়।
ডাকাত শাহীনের অপরাধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কথা বলায় থিমছড়ি এলাকার নুর হোসেনের প্রতিবন্ধি ছেলে আবছারকে পায়ে গুলি করে শাহীন গ্রুপ।
নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী নারিছবনিয়ার মোঃ মকসুদ জানান, ডাকাত শাহীনের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলায় মকসুদ ও মুফিজকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িতে হামলা চালায় শাহীন ও তার সন্ত্রাস বাহিনী। এসময় মকসুদ ও মুফিজকে না পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে এক পর্যায়ে তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এসময় লাথি ও বন্দুক দিয়ে আঘাত করে মাসুদের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সাড়ে নয় মাসের অনাগত সন্তানকে হত্যা করে শাহীন ও তার গ্রুপ।
তিনি আরো জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহীদের সংগ্রহে রয়েছে জার্মানীর তৈরী জিপসি রাইফেলসের মত অত্যাধুনিক ভয়ঙ্কর অস্ত্র। রয়েছে শতাধিক বিদেশী পিস্তল সহ দেশীয় অস্ত্র। গর্জনিয়ার অর্ধ শতাধিক পরিবারের প্রায় দুই শতাধিক মানুষ শাহীনের ভয়ে এলাকা ছাড়া। এই ঘটনাগুলো স্থানীয় প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা ও সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার দূর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গর্জনিয়ার এক ইউপি সদস্য জানান, রামু গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি যেন মিয়ানমারের এর একটি অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের যাবতীয় চোরাচালান একহাতে নিয়ন্ত্রণ করছে শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীন। বিশেষ করে অস্ত্র, মাদক, বার্মিজ সিগারেট ও গরু-মহিষ। অনেকটা প্রকাশ্য ও বাধাহীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে শাহীন। প্রতিদিন অন্ত্যত হাজারের অধিক মিয়ানমারের চোরাই গরু ও শতাধিক সিএনজি যোগে বার্মিজ সিগারেট এর পাশাপাশি পুরোদমে অস্ত্র ও মাদক পাচার করছে এই শাহীন ডাকাত।
ডাকাত শাহিনের অপরাধকর্মের ব্যাপারে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ মাসরুরুল হক অনেকটা ইতস্তত বোধ করেন। চলমান মামলা থাকার পরও ডাকাত শাহিনকে কেন আটক করা হচ্ছে না এমন প্রশ্ন করা হলে ওসি এর কোন সদুত্বর দিতে পারেননি। তবে অপরাধীদের আটকের ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানান।
এদিকে চোরাচালানের ব্যাপারে পুলিশ জিরো টলারেন্স উল্লেখ করে রামু থানার ওসি জানান, ডাকাত শাহীনকে গ্রেফতারের জন্য গতকাল যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। অভিযানের আগাম সংবাদ পেয়ে পালিয়ে যাওয়াই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে তাকে যেকোনো মূল্যে গ্রেফতার করা হয় বলে তিনি জানান।
মন্তব্য