চলতি অর্থবছরে সরকারের আর্থিক ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। তবে নতুন ঋণ নিলেও সার্বিকভাবে জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ হ্রাস পাবে। তবে বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণের বোঝা আরো বাড়বে। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ করার যে নীতি বিগত সরকারের মেয়াদে গড়ে উঠেছিলো, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটেও তা অব্যাহত রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হলে আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরি করবে নির্বাচিত সরকার। এতে ভোক্তার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে খরচ বাড়াবে এবং তা জিডিপির ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ার সঙ্গে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে সরকারের ডলারের হিসাবে বা বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বাড়বে। চলতি হিসাবের ঘাটতির মানে হচ্ছে সরকারের ডলার আয়ের চেয়ে খরচ বেশি হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতির সংকট কিছুটা কাটিয়ে থিতু হতে না হতেই দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি উসকে দিচ্ছে। এখনও অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির আকাশ। বাংলাদেশকে অনিশ্চয়তার গাঢ় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল তৎকালীন অভ্যন্তরীণ বেশকিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদান। মোটা দাগে যাকে বলে সুশাসনের সংকট।
যদিও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, চলতি অর্থবছরে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণ নিলেও সার্বিকভাবে জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ হ্রাস পাবে। রাজস্ব আয় কম হওয়ার কারণে গত অর্থবছরে ভোক্তার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের ব্যয় কমে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব বাড়ার পাশাপাশি এ খাতে ব্যয় আরও বাড়বে। দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে চড়া মূল্যস্ফীতির হারে এগিয়ে রয়েছে। করোনা মহামারির আঘাত ও বৈশ্বিক মন্দার ছোবল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ এখনও পারেনি। দেশকে এখনও চড়া মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরকারের আর্থিক সূচকগুলোর অবস্থা সম্পর্কে পূর্ভাবাসে বলা হয়েছে- আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হলে আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরি করবে নির্বাচিত সরকার। ফলে আগামী সরকার ভোক্তার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে খরচ বাড়াবে এবং তা জিডিপির ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সার্বিক ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওই ঘাটতি কমে হয়েছিল জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ ঘাটতি আবার বেড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকারের সার্বিক ঘাটতি আরও বেড়ে জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। আগামী অর্থবছরে এ ঘাটতি আরও বেড়ে তা সাড়ে ৪ শতাংশে দাঁড়াবে। এর পরের তিন বছরে তা আরও বেড়ে ৫ শতাংশের ওপরে চলে যেতে পারে। তবে আইএমএফের মতে, সরকারের সার্বিক ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে থাকলে ঝুঁঁকি কম।
জানা গেছে, গত অর্থবছরের শুরুতে ছাত্র-তরুণ নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার ও লাগামহীন মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। সার্বিক প্রবৃদ্ধি গত বছরের ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। যা এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর। মূল্যস্ফীতিতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, সুদের হার বৃদ্ধি, ঋণসংকট, ব্যাংক খাতের অনিশ্চয়তা ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অনীহা অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ প্রতিবেদনেও অনেকটা এ চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধীরগতি শুধু প্রবৃদ্ধিকেই নয়, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকেও গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশ্বব্যাংকের উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়। যা নতুন শিল্প ও উৎপাদন প্রকল্পে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত। উচ্চ সুদের হার, ব্যয়বহুল কাঁচামাল ও অনিশ্চিত মুদ্রানীতি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা সার্বিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়েছে।
তবে অর্থনীতিবিরা বলছেন, গত এক বছরে অর্থনীতির কিছু সূচকের পতন থামানো গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। তার ওপর দারিদ্র্য বাড়ছে। দেশের ব্যাংক খাতে বছরের পর বছর কোনো সুশাসন ছিল না। দেশের জিডিপি ও জনসংখ্যার তুলনায় বেশি ব্যাংক করার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। অর্থনীতিকে সহায়তা করা এসব ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল না। দুরবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন খেলাপি ঋণ। গড়ে এসব ব্যাংকের ৭৯ শতাংশ ঋণখেলাপি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ১০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলে খারাপ সংকেত যাবে।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা আকতার খাতুন বলেন, বর্তমানে ঋণ, বাজেট ঘাটতি ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা এই তিন গভীর বিভাজনরেখা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এখন পুনরাবৃত্ত এক উপাখ্যান বর্ধিত সরকারি ঋণ, কর আদায়ের ব্যর্থতা, স্থবির প্রবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার এক দুষ্টচক্র। ড. ফাহমিদা বলেন, চলতি অর্থবছরে সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে রাজস্ব ঘাটতি, নাজুক প্রবৃদ্ধি এবং অদক্ষ প্রশাসনিক ব্যয়। অর্থনীতি যেন এক অনন্ত ঘূর্ণিপাকে বন্দী, যেখানে ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণ নেয়, আর ঋণ পরিশোধ করতে আবার নতুন ঋণের আশ্রয় নেয়।
বর্তমানে সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যানগত ব্যবধান কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দুর্বলতা নয়, বরং প্রশাসনিক বিশ্বাসযোগ্যতারও এক ভয়াবহ সংকেত। এই অবস্থায় সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা মনে করেন, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে চাইলে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে দায়িত্ব ছাড়তে হবে। এ রকম দুর্বল শাসন ব্যবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সে জন্য নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার যত দীর্ঘ হবে, অর্থনীতির জন্য তত খারাপ হবে।
মন্তব্য