আনোয়ার হোসেন,কিশোরগঞ্জ(নীলফামারী)প্রতিনিধি >>> রূপসী বাংলার মনভোলানো রূপের ঋতু শরৎকে রোমাঞ্চকর ও মোহনীয় করে তোলার অন্যতম অনুসঙ্গ শুভ্র কাশফুল। ধরণিতে শরৎকে চেনা যায় এ কাশফুলে।যা কাশফুলের আলিঙ্গনে ঋতুররাণী শরৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসের প্রকৃতিতে অনুপম রুপ-সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির হয়।এমন রূপের বর্ণছটায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ধবধবে সাদা কাশফুল সিগ্ধ-কোমল ও মায়াবী রূপের ঝিলিক তুলেছে। এতে মুগ্ধ হচ্ছেন আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই।সরেজমিনে দেখা গেছে,চাঁদখানা ইউনিয়নের নগরবন ভকোর বাজার ও বাহাগিলী ইউনিয়নে উত্তর দুরাকুটি মাছুয়া পাড়া,ঠিকরি পাড়া নামক স্থানে বহমান চাড়ালকাটা নদীর জেগে ওঠা চরসহখাল-বিল,জমির আঁইলে, পরিত্যক্ত ভূমিতে কাশবন এক ভিন্নরকম স্নিগ্ধতা ও প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে স্বচ্ছ নীল আকাশ এবং সাদা মেঘের ভেলার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করেছে।নদীর শীতল পানির কল শব্দের শান্ত বাতাসে পাখির পালকের ন্যায় নরম কাশফুল গুলো যখন মৃদুভাবে দোল খায়,তখন দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন প্রকৃতির বুকে সাদা ঢেউ খেলছে। এমন দোলায় দুলতে থাকা কাশফুল দেখলে মন আনচান করে তোলে। গ্রামীণ প্রকৃতির এই নৈসর্গিক রূপ উপভোগ করার জন্য নাগরিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে স্রোতবিনী নদীর কলতান, চিকচিক করা শুনশান বালুচর, সাদা মেঘ ও কাশফুলের মিতালী উপভোগ করতে প্রতিদিনই ওই কাশবনগুলোতে ভিড় করছেন অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমীসহ নানা বয়সী মানুষ। আরো ভিড় জমিয়েছে চোট্টা চোট্টা মুনিয়া পাখিরাও। এসব পাখি কাশবনের ঘোপে ঘোপে সংসার পেতে বংশবৃদ্ধি করছে। তাদের কিচিরমিচির শব্দে কাশবন মুখরিত হয়ে উঠছে। দুরন্তপনার শিশু কিশোরের দল কাশ তুলে এনে খেলা করছে। কাশ ফুল দেখতে আসা রিয়াদ,ফারজানা,সিথি বলেন,সাদা মেঘের মধ্যে কাশফুলের সাদা রং এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে।কাশফুলের নরম ছোঁয়া আর চারপাশের মনোরম পরিবেশ মনে এক অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়।আর দূর থেকে কাশবনের দিকে তাকালে মনে হয়,শরতের সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে ধরণির বুকে। একটু বাতাস পেলে কাশফুলের সমাহার যখন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, তখন মুগ্ধ নাা হয়ে উপায় নেই। স্থানীয় প্রবীণরা জানান, একসময় জলাধার,বালুচর, পতিত জমিতে কাশবন বা আঞ্চলিক ভাষায় খেড় বাড়ির ব্যাপক সমাহার ছিল। আর শরৎকাল এলেই এসব স্থানে মনমাতানো সাদা কাশ ফুলে ভরে উঠত এবং গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-বিনোদনের খোড়াক যোগাতো। কাশ বনে বনে রাখালিরা গরু-মহিষের পাল চড়াত। তপ্ত দুপুরে বটে গাছের ছায়ায় বসে ধুয়া সুর তুলে মনের সুখে বাঁশের বাঁশি বাজাত। আবার অনেক গৃহস্থ পরিবার ছনকাশ দিয়ে রান্না ঘর ও বাড়ির উঠোনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বৈঠকখানা নির্মাণ করত।নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরের ছাউনি ও বেড়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল। ছনকাশ কাশ দিয়ে গ্রামের বধূরা ঝাটা (বারুন)সহ বিভিন্ন আকারের ডালি,দোনসহ নানা নান্দনি কুটির শিল্প তৈরি করত।কিন্তু সময়ের বির্বতনে শহর- গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা যে কয়টি কাশবন চোখে পড়ত সেগুলোও প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন কাশবন জন্মানো উর্বর ভূমিগুলো নিধন করে বিভিন্ন ফসলের মাঠে পরিণত করা হচ্ছে।গড়ে উঠছে বসতবাড়ি।এতে শরতের সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাশবন হারিয়ে যাচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সরকারি ডিগ্রী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক গীতিময় রায় বলেন, মনুষ্য সৃষ্টির নির্মমতার দরুণ তপ্তজলে ভরে উঠেছে শরতের দুই চোখ। মানুষ যদি এভাবে প্রকৃতির অনিষ্ট সাধনে আগ্রহী হতে থাকে তাহলে একদিন হয়ত শরতের সাদা ফুলের সঙ্গে আমাদের আর দেখা হবে না। হবে না কোন আলিঙ্গন। তখন শরৎকে খুঁজতে হলে উল্টাতে হবে বইয়ের পাতা। তাই হয়তো বহু আগেই কবিগুরু লিখে ফেলেছিলেন ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, / দোয়েল কোকিল গাহে না গান / কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে / যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো / জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে’। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়,মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, স্রষ্টার কি অপার সৃষ্টি’। সাদা কাশফুলের সাথে নীল মেঘ,কাশফুলের সেই শিহরণ আজ আর রোমাঞ্চকর হচ্ছেনা।কাশের বনে যেন আজ কান্নার রোল পড়েছে। তাই তো কাশবনের কান্নার রোল যেন চিরন্তন না হয় এবং বাঙালির শরতের অলঙ্কার ও কবি সাহিত্যিকদের নানা উপমায় বারবার উঠে আসা কাশবন যাতে হারিয়ে না যায় তা রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।
মন্তব্য