ভ্রাম্যমাণ প্রতিবেদক >>> বাংলাদেশের সঙ্গে একেবারে লাগোয়া পুরো সীমান্ত এলাকা কব্জায় নিয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মি। বেশিরভাগ জায়গায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার। সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আসা পণ্যবাহী জাহাজ আটক করে ট্যাক্স আদায় এবং জেলেদের ধরে নিয়ে বাংলাদেশকেও ‘চাপে’ ফেলেছে এ বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এই পটভূমিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইনে আরাকান আর্মির প্রভাব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন সংকট। তারা মনে করছেন সীমান্তে আরাকান আর্মির প্রভাবের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আদৌ হবে কি না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেরও পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বলা চলে, আরাকানের কার্যত সরকারই এখন আরাকান আর্মি। এর ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুধু বিলম্ব হবে না বরং দুরূহ হবে।
এদিকে বিশ্বগণমাধ্যমে কক্সবাজার সীমান্তের পাশে যে কোনো মুহূর্তে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা আসার সম্ভাবনার কথা প্রচার পাচ্ছে। রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো—এমন সংবাদও এসেছে বিশ্ব মিডিয়ায়। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কি নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। সেটা সরাসরি না হলেও ‘ব্যাক চ্যানেলে’ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ রাখছে বলে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান। বলেন, মানুষ মনে করে আরাকান আর্মির সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক কথা আছে যেগুলো খোলাখুলি বলা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সরকার।
কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মির (কেআইএ) সহায়তায় ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের সামরিক শাখা হিসাবে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্রুত গতিতে মিয়ানমারের বেশ কিছু অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয় সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা এ সশস্ত্রগোষ্ঠী। সীমান্তে তাদের তৎপরতা চিন্তায় ফেলেছে বাংলাদেশ সরকারকে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্তের বড় অংশ পড়েছে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়। উন্মুক্ত ও দুর্গম এ সীমান্ত দিয়ে গৃহযুদ্ধে টালমাটাল দেশ থেকে রোহিঙ্গা জনস্রোত তো আছেই; মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধের স্বর্গ হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী দুই দেশের অরক্ষিত সীমান্ত। বিভিন্ন সময় দেশটির অভ্যন্তরে চলা গোলাগুলির শব্দ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো অনিরাপদ করে তুলেছে।
গত জানুয়ারিতে নাফ নদীতে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে আসা ৪টি পণ্যবাহী জাহাজ আটক করে নিয়ন্ত্রণ নেয় বাহিনীটি। কয়েক সপ্তাহ পর ছেড়ে দিলেও আরাকান আর্মির এই জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় শুরু হয় আতঙ্ক। গত মাসে প্রায় ২০-৩০ জন জেলেকে তুলেও নিয়ে যায় তারা। বেশ কয়েক দফা জাহাজ-জেলে ছাড়িয়ে নেওয়ার পর এবার আরাকান আর্মিকে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের। গত ১ মার্চ কক্সবাজারে এক সভায় এমনটাই জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
২০১৭ সালের পর থেকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার কারণে মিয়ানমারে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বেসরকারিভাবে তা ১৩ লাখের কাছাকাছি। সর্বশেষ গত কয়েকমাসে আরও ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।
আগামী ১৩ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এই সফরে রোহিঙ্গা সংকট, রাখাইনে ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করবেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুতেরেসের সফরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া উচিত। তবে সেই ফলাফল বাংলাদেশ আদৌ পাবে কি-না সে বিষয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কারণ পেছনে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের অকার্যকারী পদক্ষেপ’কে সামনে আনছেন বিশেষজ্ঞরা।
মন্তব্য