লেখক সাদেকুল ইসলাম>>>রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক লিখেন আবু সাঈদের মৃত্যুর প্রমাণপত্র।যেখানে লেখা, ❝নাম- আবু সাঈদ, পিতা- মকবুল হোসেন,গ্রাম- বাবনপুর,পীরগঞ্জ,রংপুর। বয়স-২৫, মৃত্যুর সময়-৩:০৫, মৃত্যুর কারণ- গুলির আঘাত❞। পুরো রংপুর সেদিন শোকের শহরে পরিনত হয়েছিল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো ছাত্র ও আপামর জনতা।এই নিষ্ঠুর, নির্মম বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ভিডিও অনলাইনে শেয়ার করা হলে দাবানলের মতো জ্বলে উঠে। ফলে সারা দেশে শত শত শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, অভিভাবক, রিকশাচালকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ আবু সাঈদের মৃত্যুতে ক্ষোভ ও শোকে সংহতি প্রকাশ করেন।বিক্ষোভ দমনে পুলিশের নির্বিচার গুলি চালানো সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের প্রতিবাদে সোচ্চার করে তোলে। আন্দোলনের গতিবেগে নতুন মোড় সূচিত হয়। আবু সাঈদ পুলিশের কাছে দৃশ্যত কোনো হামলা বা হুমকির কারণ ছিল না।সাঈদের নৃশংস হত্যাকান্ডের ভিডিওটি ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং ১৬ই জুলাই থেকে বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের উপর পরিচালিত নির্মমতার প্রতীক হয়ে ওঠে।খুনি হাসিনা বিক্ষোভকারীদের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখায় ১৮ই জুলাইয়ের মধ্যে ৩২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে ১৯ জুলাই, ৭৫ জন।এসময় সরকারের তরফ থেকে আলোচনার প্রস্তাব বিক্ষোভকারীরা মৃত্যুর মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যাখ্যান করে।এমন পরিস্থিতিতে সমগ্র দেশে ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীকে সারা দেশে মোতায়েন করা হয়। কারফিউ জারি করে ‘দেখা মাত্র গুলি করা’র নির্দেশ দেওয়া হয়।জুলাই মাসেই ১০ দিনেরও কম সময়ে ২০০ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং আরও হাজার হাজার মানুষ আহত হন।গত ৫০ বছরে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের গণ জোয়ারে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বীভৎস মৃত্যুর সংখ্যা খুব কম দেশই দেখেছে। গুলিবিদ্ধ ছাত্র-জনতাকে জীবন্ত অবস্থায় জড় পদার্থের মতো পুলিশ পিক-আপ ভ্যানে একের পর এক ফেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মর্মান্তিক দৃশ্য বিশ্ববিবেককে হতবাক করেছে। সপ্তাহব্যাপি যারা নিহত, আহত এবং গ্রেফতার হয়েছেন তাদের বিচার ও জবাবদিহির দাবিতে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গর্জন বিদেশের মাটিতেও সন্বীপিত হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং প্রবাসী বাংলাদেশীরা। যারা কষ্টের রেমিটেন্স পাঠান। ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে একমাস রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ রেখেছিলেন তারা। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, আরব আমিরাত ও কলকাতায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের অভয় দিয়েছিলেন বিদেশি নাগরিকরা।আন্দোলন ও প্রতিবাদের ঢেউ দেশের আপামর জন সাধারণকে সরকারের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে। বিশেষত ১৮ জুলাই থেকে ২২ জুলাই অবধি ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সরকারের অন্যায় চাপা দেবার কৌশল হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং মানবাধিকারের রাষ্ট্রীয় দমনের চেহারা বীভৎস হয়ে উঠে। অন্যদিকে ‘বাংলা ব্লকেড’, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ অস্থিতিশীলতা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে, উপরন্তু জনগণের নিরাপত্তা এবং জীবিকাকে প্রভাবিত করে ফলে হাসিনার উপর জনতার আস্থা নিঃশেষ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা জানত যে বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া তারা সফল হতে পারবে না। আন্দোলন এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারা রাজনৈতিক দল এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই ঐক্যই আন্দোলনকে সফল করেছে, কারণ এটি সমাজের একটি বিস্তৃত অংশের কাছে আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছিল।ফলে হত্যাকান্ড, জখম, গুলি, হামলা, ভাঙচুর, সন্ত্রাসের ঘটনা দেখতে দেখতে একসময় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। ৪ আগস্ট রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় না করানোর আহ্বান জানান সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা।
মন্তব্য