শেখ ফয়সাল আহমেদ কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার >>> প্রযুক্তির কল্যাণে যেমন মানুষের জীবনে আমুল পরিবর্তন এসেছে, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল ভোগ করে মানুষ যেমন তার জীবনের অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে হয়েছে স্বাবলম্বী আবার বিপথগামী কিছু প্রযুক্তির কল্যাণে নিঃস্ব হয়ে ধ্বংস হচ্ছে মানুষের জীবন, তেমনি আধুনিক মরণব্যাধি অনলাইন জুয়ার ছোবলে মানুষ নিঃস্ব ধ্বংস হয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিচ্ছে।স্মার্টফোন ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানুষ ধরছে বিভিন্ন বাজি ধরছে, আগে সাধারণত মানুষ একত্রে বসে জুয়া খেলতো কিন্তু যুগের পরিবর্তনে হাতে স্মার্টফোনের কল্যাণে এখন যে কোন জায়গায় থেকে জড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়ায়, প্রথমে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিতরা খেলতো অনলাইন জুয়া/ক্যাসিনো কিন্তু এই ভয়ংকর অনলাইন জুয়া এখন শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, জড়িয়ে পড়ছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন চাকরিজীবী ব্যবসায়ী শ্রমজীবী নারী পুরুষ সহ সমাজের অধিকাংশ স্তরের মানুষ, প্রতিদিন এই অনলাইন ক্যাসিনোতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ডলার লেনদেন হয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথমে কিছু লাভের মুখ দেখে এরপরে লাভের নেশায় খোয়াতে থাকে জীবনের সর্বস্ব।রাজধাীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এক লক্ষ টাকার অধিক বেতনে চাকরি করতেন জামিল অনলাইন ভিত্তিক জুয়া ‘ওয়ান এক্স বেট’ ও গ্লোরি ক্যাসিনো খেলতে গিয়ে ব্যাংকে জমানো ১৭ লক্ষ টাকা, স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে ৫২ লক্ষ টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলেন ৮০ লক্ষ টাকা, মানসিক চাপে হয়েছেন মাদকাসক্ত হারিয়েছেন চাকরি এছাড়াও আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব অনেকের কাছ থেকেই করেছেন ধার দেনা সবকিছুই খুইয়েছেন অনলাইন জুয়ায়, ঋণের চাপে বিক্রি করে দিয়েছেন ফ্লাট, স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছেন আজ তিনি নিঃস্ব এবং জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, জামিল বলেন আমি বুঝতে পারিনি আমাকে কি নেশায় পেয়েছিল কেউ এ পথে পাড়া দিবেন না মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর এ পথ।রাজধানীর মিরপুরের নবম শ্রেণীর ছাত্র মামুন ,কথা হয় তার মায়ের সঙ্গে বলেন আমার একটি মাত্র ছেলে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে বাসা থেকে টাকা চুরি, লুকিয়ে আমার গহনা নিয়ে বিক্রি করেছে, ওর বাবার ৭ লাখ টাকা ছিল ঘরে সেই টাকা সহ আরো বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে মা বাবার কথা বলে টাকা এনে এই অনলাইন ক্যাসিনোতে ব্যয় করেছে, ভেবেছিল অনেক টাকা উপার্জন করে মা-বাবাকে দিবে কিন্তু এটা যে একটি সর্বনাশা পথ সেটিও বুঝতে পারেনি, মামুনের মা বলেন সরকারের উচিত অতি দ্রুত এই সমস্ত অনলাইন ক্যাসিনো জুয়াসহ অবৈধ পথগুলো দ্রুত বন্ধ করে দিতে।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাফসান বলেন আমার এক বন্ধু আমাকে একদিন দেখিয়ে দিল এবং আমি ৫ হাজার টাকা দিয়ে ৩৮ হাজার টাকা জিতেছিলাম পরবর্তীতে শুধু হেরেছি লাভের আশায় আমার বাবা একদিন আমাকে ৭ লক্ষ টাকা দিয়েছিল একটি ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য সেই টাকা আমি অনলাইন ক্যাসিনোতে ব্যয় করে হেরে গিয়েছি এবং আমার বাবার ব্যবসায়িক অনেক ক্ষতি হয়েছে আজ আমি অনুতপ্ত আমাদের পরিবারের এই দুরবস্থার জন্য আমি দায়ী আর কখনোই এই পথে যাব না।কান্তা রানী একজন গার্মেন্টস কর্মী কয়েকজন বান্ধবীদের সাথে দেখে তিনিও খেলে পাঁচ বছরের জমানো তিন লক্ষ টাকা খুইয়েছেন, লাভের আশায় বিক্রি করে দিয়েছেন নিজের কুষ্টিয়ার জমি, কিন্তু আর ফেরত আসেনি।নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাংগা ইউনিয়নের বড়ই বুনিয়া গ্রামের ভ্যানচালক আকরাম জানান খুবই ভালো ছিলাম সাত বিঘা জমি ছিল পুকুর ভর্তি মাছ ছিল কোন কিছুর কমতি ছিল না কিন্তু এই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ভিটেবাড়ি ছাড়া আজ আর তার কিছুই নেই সব কিছু খুইয়েছেন এখন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান, দুটি মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিবেন সেই চিন্তায় অসুস্থ হয়ে দুইবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন অর্থের জন্য চিকিৎসা করাতে পারছেন না ডাক্তার বলেছে অতি দ্রুত আপনার হার্টের রিং পড়াতে হবে অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমি যে ভুল করেছি আত্মহত্যা ছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ নেই কারণ আমি ঋণে জর্জরিত প্রতিদিন ভ্যান চালিয়ে আমার ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ইনকাম হয় অথচ প্রতি মাসে আমাকে সুদ গুনতে হয় ১৫ হাজার টাকা।রাজধানীর মিরপুর পল্লবীর শহীদ স্মৃতি স্কুলের প্রয়াত শিক্ষকের ছেলে ছিলেন রিয়াদ লন্ডন থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে এসেছিলেন চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগে লক্ষাধিকের উপরে বেতন পেতেন বাবার পাঁচতলা দুটি বাড়ি ছিল বাবার ব্যাংকে জমানো তিন কোটি টাকা ফিক্সড ছিল একমাত্র ছেলের কাছে সবকিছুর দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু ছেলে অনলাইন ক্যাসিনোতে আসক্ত হয়ে বাবাকে ঋণে জর্জরিত করে ফেলেছিলেন প্রতিনিয়ত পাওনাদারের অপমানে লজ্জিত ও ক্ষুদ্ধ হয়ে ছেলে রিয়াদকে বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং মিরপুর ১১ নম্বরে একটি পাঁচতলা বাড়ি ছেলেকে দিয়ে আলাদা করে দেন, কিছুদিন পরে বাবা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, রিয়াদ ক্যাসিনোতে আসক্ত হয়ে মানসিক চাপে ও যন্ত্রণায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন বাবার দেওয়া বাড়িও একে একে সব ফ্লাট বিক্রি করে দেন তবুও তাকে ছাড়েনি এই মরণব্যাধি ক্যাসিনোর নেশা এলাকাবাসী বলেন মানসিক অশান্তি ও পাওনাদারদের চাপে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হেরে যান রিয়াদ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান কয়েক মাস আগে রিয়াদের বন্ধু আরিফ বলেন সাজানো গোছানো সংসার ছিল রিয়াদের শুধু এই অনলাইন জুয়ার জন্য একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল, রিয়াদের স্ত্রী একমাত্র সন্তান নিয়ে আজ অসহায়ের মত দিন যাপন করছে।এই অনলাইন জুয়ায় যারা জড়িয়ে পড়ছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশ নিঃস্ব হওয়ার পরেই মানসিক অশান্তির চাপে হয়ে যাচ্ছেন মাদকাসক্ত এবং বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ নাটোরের সিংড়ায় লাখ টাকা হেরে গিয়ে গোলাম হোসেন (৫২) নামের এক কৃষক , গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পান দোকানদার রতন, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের সহকারী শিক্ষক মমিনুরের ছেলে শাহরিয়ার (৩২), পিরোজপুরের নাজিরপুরের ব্যবসায়ী সবুজ কুমার ওঝা(৩৪), খুলনার কয়রার হানিফ গাজী (২৫) সহ অনেকেই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গোয়েন্দা বিভাগ, বিটিআরসি , সাইবার ইউনিট এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে সারাদেশে অনলাইন জুয়ায় ৫০ লাখেরও অধিক মানুষ জড়িত, বিটিআরসি কয়েক বছরে অবৈধ প্রায় কয়েক হাজার সাইট বন্ধ করেছে, অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে একটি পরিবার বা একটি সমাজ ধ্বংস হচ্ছে না বরং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে আর এসব জুয়ার সাইট দুবাই সাইপ্রাস চীন রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশে আছে এদের প্রতিনিধি তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা।সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে অনলাইনে সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন সব থেকে বেশি প্রয়োজন এই সাইটগুলো বন্ধ করতে হবে এবং যারা এই ধরনের জুয়ার চটকদার বিজ্ঞাপনের মডেল হচ্ছেন তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে কারণ তাদের এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখে তরুণ সমাজের কারো কারো মধ্যে বিনা পারিশ্রমে হুট করে অধিক অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেকের জীবন, সরকারের কার্যকর উদ্যোগ ও কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে, সব থেকে বেশি প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা ও পারিবারিক বন্ধন জোরালো করতে হবে এবং সামাজিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে না হলে আগামীতে আরো ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে আগামী প্রজন্মের জন্য।
মন্তব্য