আনোয়ার হোসেন,কিশোরগঞ্জ(নীলফামারী)প্রতিনিধি >>> জড় পুতুল কী করে নাচে,কথা কয়,অভিনয় করে তা দেখতে কৌতুহলী ও উৎসুক মানুষের জুড়ি মেলাভার। যা এক সময় গ্রাম বাংলার অন্যাঞ্চলের ন্যায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে এ পুতুল নাচের নাট্য কাহিনী গ্রামীণ মানুষের সুুস্থ বিনোদন ধারার অন্যতম মাধ্যম ও সমাজের দর্পন ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনের ও আধুনিক প্রযুক্তির নানা বিনোদনের ভীড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ও মনোমুগ্ধকর পুতুল নাচ। যা পহেলা বৈশাখসহ গ্রামীণ বিভিন্ন বান্নি মেলায়,নানা উৎসব পার্বনে,খোলা মাঠে-ময়দানে আলোক উজ্জল মঞ্চে পুতুল নাচের জমজমাট আসর বসত। আর লোকায়েত জ্ঞানে কাঠ ও রঙ-বেরঙের কাপড়ের সু-সজ্জিত পোশাক দিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন চরিত্রের পুতুল।মানুষের অবয়য়বে প্রাণবন্ত এ পুতুল গুলো সুতার নাটাই ও কন্ঠের ভেলকিবাজি দিয়ে নাচ,গান ও নানা চরিত্রের অভিনয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়,রাজা বাদশাহ ও পৌরাণিক কাহিনীসহ জীবনের নানা দিক নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হত। যা ছিল সব বয়সি মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের নির্মল আনন্দ-বিনোদন ও নানা শিক্ষনীয় বিষয়ের বিশাল ভান্ডার। আর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ও শিশু কিশোরের দল তুমুল আগ্রহ ভরে তা উপভোগ করত। কিন্তু সেদিন বদলে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে স্বকীয়তা ও রুচিবোধের অভাব,কর্ম ব্যস্ততা,সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন।ফেসবুক,গুগল, ইউটুবে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বিনোদনের সহজ লভ্যতা। ঘরে ঘরে আকাশ সংস্কৃতির নানা বিনোদন।এতে চিরায়িত গ্রাম বাংলার সুস্থ বিনোদন ধারার অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম পুতুল নাচের জৌলুস বিলীন হয়ে যাচ্ছে।বর্তমান প্রজন্মের কাছে যেন রুপকথার গল্প। পাশাপাশি এ শিল্পের সাথে জড়িতরা জীবন- জীবিকার রসদ খুঁজে না পাওয়ায় পেশা বদল করাসহ অনেকে অর্থ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কালেভদ্রে এ পুতুল নাচের দেখা মেলে উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের সম্প্রতি সময়ে অনুষ্ঠিত মেলাবর টটুয়ার ডাঙ্গার বান্নি মেলার মনসা মঙ্গল যাত্রা ইউনিট মঞ্চে। পুরনো পুতুল নাচের ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে বান্নি মেলার অন্নপূর্ণা মন্দির কমিটি এর আয়োজন করেন। এসময় দেখা যায়,মঞ্চে নানা নাট্য কাহিনী অবলম্বনে সাজানো রঙবে-রঙের মোহনীয় পুতুলের নাচ, সেইসঙ্গে নানান বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ও রঙবে-রঙের আলোর ঝলকানি টটুয়ার বান্নি মেলা হয়ে উঠে পুতুল নাচের এক উৎসবমুখর পরিবেশ। তা দেখতে দূর দূরান্তের নানা বয়সি মানুষজন ভিড় জমান।আসর হয়ে উঠে জমজমাট। মোবাইল ফোন,ইউটিউব-ফেসবুকে বুঁদ হয়ে থাকা বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরা চোখের সামনে মোহনীয় পুতুল নাচের নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়ে বিমোহিত হয়ে পড়েন। তারা জানান,এত দিন বই-পুস্তকে পুতুল নাচের কথা ও ছবি দেখেছি। আজ বাস্তবে দেখে বড্ড আনন্দ লাগছে। পাশাপাশি কয়েক দশক পর ছোটবেলাকে ফিরে পেয়ে খুশি এলাকার বয়স্করাও। কথা হয়, ওই মন্দির কমিটির সভাপতি বীরেন্দ্র নাথের সাথে।তিনি বলেন, ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী টটুয়ার বান্নি মেলায় বাপদাদারাও পুতুল নাচের আসর বসাতেন। সে সময়ে পুতুল নাচ উপভোগ করার জন্য পরিবার-পরিজন ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষের ঢল নামত। তারা ২টাকার টিকিটের বিনিময়ে দীর্ঘ সময় ধরে পুতুল নাচের নানা নাট্যকাহিনী উপভোগ করত। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনের জগতে ছোট-বড় সবাই মেতে উঠেছে।আগের মত মেলায় লোক সমাগমও তেমন হয় না। এতে জৌলুস হারাতে বসেছে বান্নি মেলার ও আদি গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির পুতুল নাচের। পুতুল নাচের ম্যানেজার সুকুমার রায় বলেন,পুতুল নাচের কাহিনী গুলো সাধারনত লোককথা, রূপকথা এবং সামাজিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো হয়।যা ৯০দশক আগেও গ্রাম-গঞ্জের নানা উৎসবকে ঘিরে এ পুতুল নাচের জাঁকজমকপূর্ণ আসর বসত। হাঁক ডাক ও ছিল দেশ জুড়ে। আয় রোজগারও ছিল ভাল। এখন সেই পুতুল নাচের সোনালী দিন আর নেই।আধুনিক যুগের নানা কুরুচিপূর্ণ বিনোদনের ছড়াছড়িতে মানুষও খুব একটা পুতুল নাচ দেখতে আগ্রহ দেখায় না। লাভও নেই সেই আগের মত। যতই কষ্ট-ক্লেশ হউক বাপ-দাদার রেখে যাওয়া আদি পেশা ও গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ধরে রাখতে মুলত এ প্রয়াস। প্রবীণরা বলেন,এক সময় পুতুল নাচ বাংলার গ্রামীণ মানুষের মননে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল।আধুনিক সভ্যতার যুগে বাংলার এই প্রাচীন সংস্কৃতি কালের অতল গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক সভ্যতায় সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে গিলে খাচ্ছে বাচ্চাদের শৈশব-কৈশোর। তাই শিশুদের সৃজনশীল ও মননশীল হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে যাতে গ্রাম বাংলার আদি ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতির পুতুল নাচ হারিয়ে না যায় এ জন্য সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসা একান্ত দরকার। কিশোরীগঞ্জ বহুমুখী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম আজম বলেন,একসময় গ্রামীণ বিনোদনের ভূবনে মনোমুগ্ধকর ও জনপ্রিয় ছিল পুতুল নাচের।যা ছোট বেলায় পুতুল নাচ দেখে খুবেই মুগ্ধ হয়েছিলাম।পুতুল নাচ শুধু বিনোদন নয়,এটি একটি শিক্ষামূলক মাধ্যমও বটে।সমাজে নানা অসংগতি, নৈতিকতা এবং মুল্যবোধের শিক্ষা দিতে এই শিল্পটির জুড়ি মেলাভার।আজ এ শিল্পটি নানাবিধ কারণে হারিয়ে যাচ্ছে।শিল্পটি রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।
মন্তব্য