জেলে বসেই চোরাচালান সক্রিয় করতে মরিয়া ‘ডাকাত শাহিন’ গ্রুপ
আবারো মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসছে গবাদি পশু ও ইয়াবা
ডাকাত শাহীনের সাম্রাজ্যের নতুন রাজাও গ্রেপ্তার, নড়বড়ে হলো চক্রান্ত
গ্রেপ্তার আবছার ডাকাত ছিল শাহিনের অন্যতম হাতিয়ার
জেলে বসেই আবছারকে দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ছিল ডাকাত শাহীনের
আবছারের হাতেই নির্যাতনের শিকার কয়েকটি পরিবার
শাহিনের নির্দেশে সীমান্তে সক্রিয় হতে মরিয়া তালিকাভুক্ত ২২ চোরাকারবারি
আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার।। কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্তে গরুকাণ্ডে জড়িত রাঘববোয়ালরা রাজনীতিতে। আছে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মাঝে এবং প্রশাসনেও। তবে দৃশ্যপটে দেখা মিলছে শুধু চোরাকারবারিদের। দীর্ঘদিন ধরাছোয়ার বাইরে থাকা রাঘববোয়াল খ্যাত শাহিন ডাকাত যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। একে একে ধরা পড়ছে শাহীনের বিভিন্ন শাখা-উপশাখার কমান্ডাররা। তাদের থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ। এছাড়াও জব্দ করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক মিয়ানমারের অবৈধ গরু। তবে, তাদের কেউ কেউ আইশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আদালতে মিথ্যা মামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নানান অপতৎপরতা শুরু করেছেন। নতুন করে সীমান্ত চোরাচালান শুরুর লক্ষ্যে ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে শাহিনের ডান হাত খ্যাত নিরুপম শর্মা নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিশাল সিন্ডিকেট। জেলে বসেই চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে ডাকাত শাহিন। আর শাহিনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছিল নুরুল আবছার ওরফে ডাকাত আবছার। তাকেও অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার করেছে বিজিবি।
যেভাবে চোরাচালানের জন্য আলোচিত গর্জনিয়া-নাক্ষ্যংছড়ি: অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাচালানের জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত রামুর গর্জনিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা। স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও দেশের কয়েকটি শীর্ষ মাফিয়া গ্রুপ ডাকাত শাহীনের সেল্টার দাতা হিসেবে কাজ করছিল। চলতি বছরের ৫ জুন সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবের যৌথ অভিযানে কুখ্যাত চোরাকারবারি, সন্ত্রাসী শাহীন ডাকাতকে অস্ত্রসহ এবং একই সাথে ৩১ টি গরু ও একটি ছাগল জব্দ করা হয়। শাহিন ডাকাত ও সহযোগীদের থানায় মামলা মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয় এবং আটককৃত গবাদি পশু বিজিবির তত্ত্বাবধানে কাস্টমস মাধ্যমে নিলাম করে সরকারি কোষাগরে টাকা জমা করেছে সংশ্লিষ্টরা। বড় চক্রটির সিন্ডিকেট প্রধান ধরা খাওয়ার পর তার সহযোগীরাও ধরা পড়ছে। এতে প্রশাসনের উপর বেশ ক্ষিপ্ত চোরাকারবারিরা। তাদের নতুন ফাঁদ আদালতে মিথ্যে তথ্য উপস্থাপন করে শীর্ষ চোরাকারবারি শাহিন ডাকাতকে জামিনে মুক্ত করার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলাকে দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করার নিমিত্তে সাপোর্টিং নথিপত্র প্রস্তুত করা এবং আভিযানিক দলের সদস্যদের হয়রানি করা। তারই অংশ হিসেবে যৌথ অভিযানে জব্দ করা ৩১টি চোরাই পথে আসা মিয়ানমারের গরুকে নিজের দাবি করে অভিযানের প্রায় একমাস পর অতি গোপনে গেল ১০ জুলাই বিজিবির ৬ সদস্য এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহিনকে আটকের আভিযানিক কার্যক্রমের প্রধান তথ্যদাতার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার আবেদন করে ডাকাত শাহিনের ক্যাশিয়ার, বিভিন্ন অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ক ও একাধিক মামলার আসামী নুরুল আবছার ডাকাত। তার বিরুদ্ধে পুর্বে হত্যা, সশস্ত্র চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে একাধিক মামলা রয়েছে। মামলার আবেদনে- চোরাকারবারি নুরুল আবছার ৩১টি গরু তার খামারের বলে দাবি করেন। কিন্তু তার বাড়ির সঙ্গে যৌথ বাহিনীর অভিযানের দূরত্ব অনেক। আর ডাকাত শাহিনের আস্তানার গরু কিভাবে তার হয় এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঘটনাস্থলে যায় এই প্রতিবেদক।
শাহিনের সাম্রাজ্যে প্রশাসনের তৎপরতা: সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়-যৌথ বাহিনী গেল ৫ জুন শাহিন ডাকাতকে গ্রেপ্তারের পর তার আস্তানা ও নিকটবর্তী পৃথক কয়েকটি স্থানে থাকা বার্মিজ গরু-ছাগল জব্দ করে। যা পরবর্তীতে ডাম্পার ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়। সেখানে নিলাম করা অর্থ জমা হয় সরকারের কোষাগরে। যার নথি প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। অভিযানস্থল গর্জনিয়ার মাঝিরকাটা হলেও আবছার ডাকাতের বাড়ি বোমাংখিল এলাকায়। কয়েক কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত হলেও শাহিন ডাকাতের বিশ্বস্ত সহযোগী, হত্যা মামলার আসামি,চোরাকারবারি নুরুল আবসারের মাধ্যমে তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আভিযানিক দলকে হয়রানি করে চলমান কঠোর অভিযানকে দমিয়ে রাখার তৎপরতা প্রকাশ করে। মামলার আবেদনে উল্লেখ্য করা দুই সাক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এই প্রতিবেদক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই সাক্ষী জানান, ‘জেলে থাকা শাহিন ডাকাত নিরুপম শর্মা ও তার অন্যতম হাতিয়ার আবছার ডাকাতকে ব্যবহার করে মামলাটির আবেদন করেছে। তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। শাহিনকে গ্রেপ্তারের দিনই এসব গরু জব্দ করে বলেও জানায় তারা।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা শাহিনের পাশে ছিল: অভিযোগ আছে, শাহিন ডাকাত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও ও প্রশাসনের কতিপয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গ তাকে শেল্টার দিতেন। শাহীনই মূলত চোরাচালানের প্রধান, গর্জনীয়- রামু – নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় ত্রাস, আতঙ্ক ও সীমান্ত সন্ত্রাসের মূল হোতা। তার মাধ্যমে চোরাচালান ব্যবসা করতেন আওয়ামী লীগের নেতারা। যার কমিশনের বড় অংশ পেতেন সাবেক সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমলও। পুলিশকে বুঝিয়ে দিতেন তাদের পাওনা। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তিনি সখ্য গড়ে তুলেছিলেন বিএনপি ও অন্যদের সঙ্গে। তবে এড়াতে পারেননি গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তারের পর জেলে গেছেন। সেখানে বসেই গড়ে তুলেছেন নতুন সিন্ডিকেট। যা দিয়ে প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে চোরাচালান চালুর প্রক্রিয়া শুরু করতে মরিয়া।
শাহিনের নির্দেশে সীমান্তে সক্রিয় হতে মরিয়া তালিকাভুক্ত ২২ চোরাকারবারি: আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তথ্য বলছে-চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে আবারো মিয়ানমার সীমান্তে সক্রিয়া তালিকাভুক্ত ২২ চোরাকারবারি। আসছে গবাদি পশুও। যাদের মধ্যে শাহিনের পরে সবচেয়ে আলোচিত আবছার ডাকাত। নতুন করে এসব চোরাকাবারিকে সক্রিয় করতে সংগঠিত করছে শাহিন ডাকাত। যাতে জেলে বসেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় সীমান্ত চোরাচালান।‘দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে কাজ করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমাদাদুল হক। তারমতে-চোরাচালান বন্ধ হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই বিতর্কে ফেলেন অসাধু চক্র। তাদের এই অপতৎপরতার ফাঁদে বাধাগ্রস্ত হয়ে অনেক কর্মকর্তাই চোরাচালান বিরোধী অভিযানে নিরুৎসাহিত হয়ে যান।ফলে, এ ধরনের চোরাচালান এবং অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুনরায় চোরাকারবারি, সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আবার রাজত্ব কায়েম করে। এ সবকিছু গায়ে না মাড়িয়ে সীমান্তের নিরাপত্তা ও চোরাচালান প্রতিরোধে বর্তমান কঠোর অবস্থান বজায় রেখে আরও সক্রিয় থাকার আহবান তার।
যেভাবে শাহিন ডাকাত গ্রুপের অপতৎপরতা প্রকাশ্যে: সূত্রে জানা গেছে-শাহীনের ডাকাত গ্রুপের সাপোর্টিং টিম শাহীন ডাকাতের জামিনের জন্য বড় অংকের টাকা বাজেট হিসেবে পরিকল্পনা করেছে (এরই মধ্যে কিছু অংশ বিনিয়োগও হয়েছে)। জামিনের পরিকল্পনা অল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর করা সম্ভবপর হবে না জেনেও তারা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে এবং নিরবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চলমান রেখেছে। শাহীন ডাকাতের চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সিন্ডিকেটটি ৫ জুনের যৌথ অভিযান সম্পর্কিত মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে (যা ভবিষ্যতের শাহীন ডাকাতের জামিনের ডকুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হবে) এবং মামলা দায়েরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যার ব্যাপারে অভিযুক্তদের জানানো হচ্ছে না এবং সকলের অগোচরে হয়রানি এবং অপপ্রচারমূলক মূলক মামলা দায়েরের নিমিত্তে অর্থের বিনিময়ে গোপনে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রয়োজনীয় পেপার কাটিং তৈরি করে রাখছে। এমনকি পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে তদন্তের জন্য অবগত ও করছে না।এই নথিগুলো শাহীন ডাকাতের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোকে দুর্বল করতে এবং মামলার ফোকাসিং ভিন্ন খাতে নিতে সাহায্য সাহায্য করবে। মামলাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করে তারা জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে চায়—যেমন: শাহীনের মানবিক কর্মকাণ্ড, ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ কার্যক্রম, মসজিদ-মাদরাসায় সার্টিফিকেট বিতরণ প্রোগ্রামে তার নাটকীয় উপস্থিতি দেখিয়ে। তারা প্রয়োজনীয় নথিপত্র প্রস্তুত করছে যাতে আদালতে উপস্থাপনের মাধ্যমে শাহীন ডাকাতকে জামিন করাতে পারে। শাহিন ডাকাতের স্থানীয় এজেন্ট, ব্যবসায়িক অংশীদার ও প্রশাসনিক বিষয়ের সমন্বয়কারী নিরুপম শর্মা এবং মাসুদ। এই গ্যাং, নুরুল আবসারসহ চোরাকারবাড়িদের সুনির্দিষ্ট পেশা না থাকলেও, এদের রয়েছে ইটের দালান ও বিপুল অর্থ সম্পদ। তেমনি প্রত্যন্ত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এদের গডফাদার শাহিনের রয়েছে কোটি টাকার বাড়ি-গাড়ি অর্থ-সম্পদ।গর্জনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার সন্ত্রাস, চোরাচালান কার্যক্রমের সাথে জড়িত পূর্বের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট গোপনে সীমান্ত এলাকা অস্থিতিশীল রেখে শত কোটি টাকার চোরাচালানী ব্যবসা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পুনরায় চলমান করার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তৎপর হয়েছে। চোরাচালান সিন্ডিকেট পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং তাদের অবৈধ কার্যক্রম আবারও শুরু করার তৎপরতা সরজমিনে ও গোয়েন্দা তথ্যে উঠে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্ণেল মহিউদ্দিন আহমদে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিজিবির তৎপরতায় সীমান্ত চোরাচালান বন্ধ থাকলেও আবারো চক্রটি সক্রিয় হবার চেষ্টা করছে। চক্রটির প্রধান ডাকাত শাহীন যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হবার পর সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ ছিল। তার একাধিক সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এক প্রশ্নের জবাবে সেক্টর কমান্ডার বলেন, ‘জেলে বসেই হয়তো চক্রটিকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন ডাকাত শাহীন। বাহিরে আবার তার বিচ্ছিন্ন কিছু গোষ্ঠী বিজিবির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। আমরা তাদেরকেও শনাক্ত করেছি। তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সীমান্তে কঠোর অবস্থানের কথা জানান বিজিবির এই কর্মকর্তা।
মন্তব্য