২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |
  • প্রচ্ছদ
  • আন্তর্জাতিক >> জাতীয় >> রাজনীতি
  • কেমন হবে ‘দ্যা চেঞ্জ মেকার’ এরদোয়ানের ভবিষ্যত পথচলা।
  • কেমন হবে ‘দ্যা চেঞ্জ মেকার’ এরদোয়ানের ভবিষ্যত পথচলা।

      বাংলাদেশ সংবাদ প্রতিদিন

    রিপোর্ট: অধ্যাপক শাব্বির আহমদ >>> আগামী পাঁচ বছরের জন্য আবারও তুরস্কের মসনদ সামলানোর দায়িত্ব পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোয়ান। ২০২৩ এর ১৪ মে প্রথম রাউন্ডে, ২৮ মে দ্বিতীয় রাউন্ডে অনুষ্ঠিত আধুনিক তুরস্কের বিগত ১০০ বৎসের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নির্বাচনটি ছিল ২০ বছর ধরে তুরস্কের ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য চরম অগ্নিপরীক্ষা। দেশের ভেতরে-বাইরে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি এরদোয়ান যেন হারতে হারতে জিতে গেলেন। তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিদিন শাসনকারীর তকমা ইতিমধ্যেই তাঁর ঝুলিতে। দৈবিক কিছু না ঘটলে আরো পাঁচ বৎসর তিনি তুরস্ক শাসন করবেন। বাম-ডান-সেক্যুলাররা একজোট হয়েছিল কামাল আতাতুর্কপন্থী কট্টর সেক্যুলারিস্ট কামাল কিলিচারওগ্লোর নেতৃত্বে। এই জোটকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পশ্চিমাদের প্রোপাগান্ডা, তথাকথিত জনমত জরিপকে অসার প্রমাণ করে দিয়েছে এরদোয়ানের এই বিজয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, যে এরদোয়ানকে একদিনের জন্যও ক্ষমতার মসনদে দেখতে না চাওয়া মার্কিন প্রেসিজেন্ট জো বাইডেন ফলাফল ঘোষণার পরপরই সবার আগেই অভিনন্দন জানিয়েছেন।কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে পুরোপুরি উঠিয়ে দিয়েছিলেন। ইস্তাম্বুলে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এরদোয়ানকে তাঁর ধার্মিত পিতা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাদ্রাসার বিকল্প ‘ইমাম হাতিপ’ নামক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। উক্ত প্রতিষ্ঠানে স্নাতক পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কুরআন, হাদিস ও আরবী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ইসলামের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা ও আনুরাগের জন্ম ইমাম হাতিপ থেকেই। ছাত্রজীবনে ফুটবলার হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। একসময় তার মনে হলো ইসলামকে শুধু হৃদয়ে ধারণ করলেই হবেনা, ছড়িয়ে দিতে তুর্কি সমাজেও। ১৯৭৬ সালে যোগ দিলেন কমিউনিস্ট বিরোধী এ্যাকশন পার্টিতে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর অন্যান্য দলের ন্যায় তার দলও নিষিদ্ধ হলো। এবার তার মধ্যে ধারণা জমলো, কামাল পাশার ইসলাম বিরোধী কট্টর সেক্যুলার সংবিধান ইসলামী দল ও মতকে কখনো গ্রহন করবে না। তিনি উদার পন্থার দিকে পা বাড়ালেন। নীতি গ্রহন করলেন মুখে জাতীয়তাবাদ, হৃদয়ে ইসলাম। এখনো সেই পথেই আছেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন নাজমুদ্দিন এরবাকানের ইসলামিস্ট ওয়েলফেয়ার পার্টিতে। এরদোয়ান ১৯৯১ সালে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েও বসতে পারেননি পার্লামেন্টে। ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হয়ে পাল্টে দেন ইস্তাম্বুলের চেহেরা। পুরো তুরস্কব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এরদোয়ানের সুনাম সুখ্যাতি। ‘নতুন তুরস্ক’ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০০১ সালে একে পার্টি গঠন করে ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ২০০৩ সাল হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরষ্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তুরস্কে নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি চালু করেন এরদোয়ান। এরদোয়ান কেবল নিজ দেশের মানুষের মন জয় করেননি, তুরস্কের সীমানা ছাড়িয়ে দুনিয়াব্যাপি তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার বিজয়ে আনন্দ উল্লাস করতে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা নেমে এসেছে তুরস্কের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজপথেও। এরদোয়ানের এই দীর্ঘ সফলতার পথচলা মোটেই সহজ ছিলো না। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তাঁকে এখানে এসে পৌঁছতে হয়েছে। গ্রহণ করতে হয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ, মোকাবেলা করতে হয়েছে বড় বড় বাধা। কিন্তু তিনি থেমে যাননি, শুধু সামনেই এগিয়েছেন। ‘যত শত্রু তত মর্যাদা’- পুরোনো এই জার্মান প্রবাদকে কাজেকর্মে ফলিয়ে ফুলিয়ে তুলছে এরদোয়ান। ইরান ও আজারবাইজান ছাড়া আর সব প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা তার। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে গ্রিসের সঙ্গে বিবাদ প্রায় সামরিক সংঘর্ষের পর্যায়ে গিয়ে থামলেও বন্দুকের বারুদ এখনো উত্তপ্ত। সিরিয়া ও ইরাকে কখনো আসাদ বাহিনী, কখনো কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে তুরস্ক। এরদোয়ান লিবিয়ায় থামিয়ে দিয়েছে ফ্রান্স ও রাশিয়া-সমর্থিত বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের বাহিনীর অগ্রযাত্রা। আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধে আর্মেনিয়ার প্রতিবেশী রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান দেশ আর্মেনিয়ার কবল থেকে উদ্ধার করে দিয়েছে আজারবাইজানের নাগরনো-কারাবখ অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম কোন খ্রিস্টান রাষ্ট্রের উপর মুসলিম রাষ্ট্রের আক্রমণ এবং জবরদখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার।ইতিপূর্বে কোন অমুসলিম রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে হয় অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে, নয়তো পরাশক্তিগুলোর দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে।১ম বিশ্বযুদ্ধে বৃটেনের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির যুদ্ধজয়ের ফলে চরম দুর্যোগ নেমে আসে প্রায় সাড়ে ছয়শত বৎসর মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বর্তমান ৩৫টি দেশ শাসনকারী অটোমানদের উপর। লুজান চুক্তি দ্বারা ১৯২২ সালে উত্তর আনাতোলিয়াকে স্বাধীন তুর্কি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে আরব, পারস্য, গ্রিক ও বলকান অঞ্চল থেকে সরে আসতে হয় কামাল আতাতুর্ককে। বাকি অংশ ভাগবাটোয়া করে নেয় ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, গ্রিস, রোমানিয়া। লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের মালিকানাধীন সাইপ্রাসসহ ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জ গুলো গ্রিসের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় এবং ভূমধ্যসাগর, কৃঞ্চসাগর ও এজিয়ান সাগরে তেল-গ্যাস উত্তলন থেকে বিরত রাখা হয়। বসফরাস প্রণালীকে যেকোন দেশের জাহাজ চলাচলের জন্য উম্মুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। লুজান চুক্তির অনেক সীমাবদ্ধতার পরও এটিকে একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুর্কি সেকুলাররা। শুরু থেকেই সেক্যুলারিস্টরা পররাষ্ট্রনীতিতে ইউরোপ এবং আমেরিকাকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু, লুজান চুক্তি দ্বারা শৃঙ্খলিত তুরস্কের অর্থনীতিকে দুর্বল করে রাখার ফলে ইউরোপের রুগ্ন দেশের তকমা লেগে যায় তুরস্কের গায়ে। বছরের পর বছর দেনদরবার করেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য লাভ সম্ভব হয়নি। ১৯৫২ সালে দেশটি ন্যাটোতে অংশগ্রহণ করেও আক্ষরিক অর্থে তুরস্ক আমেরিকার অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। অপমানজনক লুজান চুক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য মুখ খোলেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তিনি প্রকাশ্যে এ চুক্তির গুরুত্বকে প্রত্যাখ্যান করে বক্তৃতা বিবৃতি শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো একে পরাজয় বলে অভিহিত করেন। তিনি বারবার বলে আসছেন, লুজান চুক্তি ভূমধ্যসাগর ও কৃঞ্চসাগরে তুর্কি উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০১৮ সালে জাতিসংঘে ভাষণদানকালে দ্ব্যর্থহীনকন্ঠে ঘোষণা দেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের ন্যার্য অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখালে ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে, আঙ্কারা প্রয়োজনে তা ছিড়ে ফেলে দেবে। এরদোয়ান এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয় আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব।

     

    ২০০৩ সাল থেকে দেশটির নেতৃত্বদানকারী এরদোগানকে আতাতুর্কের পর সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক নেতা বলে গণ্য করা হয়। তিনি তুরস্ককে সামরিক ও শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নেতৃস্থানীয় ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ইস্পাত-দৃঢ় নেতৃত্বে তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দশটি সমরাস্ত্র বিক্রেতা দেশের অন্যতম। তুরস্কের সমরাস্ত্র ভান্ডারে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক যতোসব অস্ত্র। এসব অস্ত্রের সফল প্রয়োগ ও অপারেশন কৌশল দেখে তাবৎ বিশ্ব আজ বিস্ময়ান্বিত। এরদোয়ান শুধু তুরস্ক সংক্রান্ত বিষয়েই না, মুসলিম বিশ্বের একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে বারবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন। সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ানকে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মনে করা হয়। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ মুসলিম বিশ্বের যেকোন সমস্যার ব্যাপারে সোচ্চার এরদোয়ান। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা এবং গাজা অঞ্চলকে “উন্মুক্ত কারাগার” হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। সুতরাং, আজ ককেশাসের পাহাড়ে, সাহারার মরুভূমিতে, আফ্রিকার জঙ্গলে, উপসাগরীয় অট্টালিকায়, দক্ষিণ এশিয়ার মাটির ঘরে, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে যদি এরদোয়ানের জন্য মানুষের মন কাঁদে; তাহলে ধরে নিতে হবে এরদোয়ান ওই অঞ্চলের মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন।

     

    দীর্ঘ দুই দশকের শাসনামলে দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কমানোর পাশাপাশি হার্ড ও সফট- দুই ধরনের পাওয়ারের সমন্বয় ঘটিয়ে তুরস্ককে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন এরদোয়ান। কূটনীতি ও সামরিক শক্তির সমন্বয়ে পরাশক্তিগুলোকে কখনও পক্ষে, কখনও বিপক্ষে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে কোনো বলয়ে ঢুকে পড়েন নি। সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঝানু খেলোয়াড় এরদোয়ান গত দুই দশকে রুশ-মার্কিন উভয় শক্তির সঙ্গেই খেলছেন চতুর এক খেলা। রাশিয়ার যুদ্ধবিমান তুর্কি আকাশে ঢুকে পড়লে সেটা ভূপাতিত করে রাশিয়ার সঙ্গে যখন দূরত্ব তৈরি হয়, সেই অবস্থায় পক্ষে টানেন ন্যাটোভুক্ত দেশ হিসেবে ইউরোপ ও মার্কিন সমর্থন। আবার সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দি দমনে নেন রাশিয়ার সমর্থন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এরদোয়ানের উচ্চাভিলাষের সঙ্গে আসল সংঘাত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানের নাগরনো কারাবাখ- সবখানেই এরদোয়ান ঠেকিয়ে দিয়েছেন রুশ প্রভাব। তবে আমেরিকার সাথেও কম যাননি। ২০১৭ সালের দিকে আমেরিকার তত্বাবধানে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলে তুরস্কের কুর্দি জনগণের মাঝে স্বাধীনতার স্পৃহা পুনরায় দেখা দেওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হলে কালবিলম্ব না করে এরদোয়ান মার্কিন হুমকি-ধমকি তোয়াক্কা না করে ২০১৭,২০১৮ ২০১৯ সালে সিরিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক চালিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে কুর্দিদের বিদ্রোহীদের সিরিয়ার অনেক ভেতরে ঠেলে দিয়ে নিজ দেশে আশ্রিত ৩৬ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীদের পুনর্বাসন করার লক্ষ্য ৪৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাপার জোন গঠন করে আমেরিকার পরিকল্পনাকে বানচাল করে দেয়। ২০২০ সালে কৃঞ্চসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে করে গ্রিসে সাথে চরম উত্তেজনাকে মুহূর্তে গ্রিস আমেরিকা ও ফ্রান্সকে সাথে নৌ মহড়ার আয়োজন করলে এরদোয়ান রাশিয়াকে সাথে নিয়ে পাল্টা নৌ মহড়ার ঘোষণা দিলে নড়েচড়ে বসে আমেরিকা। রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রেক্ষিতে আমেরিকার কিছু পদক্ষেপের বিপরীতে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন এরদোয়ান। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য রাশিয়ার এস-৪০০ ব্যবহার সীমিত করারও ইঙ্গিত দেন। যে চীনকে কোণঠাসা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে, সেই চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হস্তগত করতে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ও জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান তৈরির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করেন। সিরিয়ায় সেনাঘাঁটির পর লিবিয়ায়ও সামরিক ঘাঁটি বানানোর পথে তুরস্ক আজারবাইজানেও তুর্কি ঘাঁটি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তুরস্কের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে তার দরকার লিবিয়ার তেল; সম্ভব হলে কয়েকটি তেলখনির দখল। আজারবাইজানের তেল-গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে তুরস্ক আসে। কৃষ্ণসাগরের বিপুল তেলভান্ডার আবিষ্কার এবং লিবিয়া-সিরিয়া-ইরান-ইরাক ও আজারবাইজান থেকে আমদানি করা তেল-গ্যাসের নিশ্চয়তা তুরস্ককে জ্বালানির জন্য অতিমাত্রায় রুশ নির্ভরতরা থেকে বের করে আনবে নিঃসন্দেহে। রুশ বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক দিমিতার বেশেভের ভাষায়, ‘তুরস্কের দুই পাশে তেল ও গ্যাস উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণে ককেশীয় অঞ্চল এবং জ্বালানির ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এ অবস্থানগত সুবিধাই হলো তুরস্কের হাতের ট্রাম্প কার্ড। তুরস্কের কৃষ্ণসাগরে বিরাট গ্যাস মজুত আবিষ্কার আসলেই খেলার নিয়ম বদলে দেবে। কৃষ্ণসাগরে জ্বালানি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার তুরস্কের দর-কষাকষির ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। মূলত, তুরস্কের ভূ-কৌশলগত অবস্থান দেশটির জন্য সবদিক দিয়ে আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।

     

    প্রসিডেন্ট এরদোয়ান দেশের স্বার্থে কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নয়। ধারণা করা হচ্ছে, তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতার মসনদে বসে এরদোয়ান অতীতের ন্যায় আরো কিছু দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেন। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী যেকোন চুক্তির মেয়াদ ১০০ বৎসর। সে অনুযায়ী চলতি বৎসর লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এরদোয়ান যেকোনো সময় বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচলের উপর তুরস্কের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও করারোপের ঘোষণা দিতে পারেন। এতে করে তুরস্কের অর্থনৈতিক চিত্র দ্রুত পাল্টে যাবে নিঃসন্দেহে। রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশ সমূহের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ বসফরাস প্রণালী। অন্যদিকে আমেরিকার কৃঞ্চসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ এই প্রণালী। পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর এলাকায় গ্রিসের এমন বহু দ্বীপ আছে, যা তুরস্কের খুব কাছে এবং উপকূল থেকে দেখা যায়। লুজান চুক্তি দ্বারা এগুলো গ্রিসের হাতে তুলে দেয়া হয়। ফলে এখানে কার সমুদ্রসীমা কোথায়- তা নির্ধারণ করা একটি জটিল ব্যাপার। গ্রিস যদি তার সমুদ্রসীমা ছয় মাইল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১২ মাইল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে তাহলে তুরস্কের যুক্তি অনুযায়ী তার নিজের সমুদ্রপথগুলো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রিসের কাস্টেলোরিজো দ্বীপের অবস্থান হচ্ছে তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। পক্ষান্তরে, গ্রিস থেকে প্রায় পাঁচশত কিলোমিটার দূরে। তুরস্ক ইতোমধ্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে এসব দ্বীপ ফেরত দিতে বলেছে গ্রিসকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বারবার বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের ন্যার্য অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখালে তুরস্কের মানুষকে তাদের মূল ভূখণ্ডে আটকে রাখতে ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে, আঙ্কারা প্রয়োজনে তা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। এমতাবস্থায়, গ্রিসের দখলে থাকা তুরস্কের আশেপাশের দ্বীপ গুলো পুনরায় দখলে নিতে যেকোন সময় ঝটিকা অভিযান চালাতে পারে তুরস্ক।

     

    বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্ষমতা প্রদর্শনের অন্যতম উপাদান হলো সামরিক সক্ষমতা। অর্থনীতি, মিলিটারী ও প্রযুক্তির হার্ড পাওয়ার, সফট পাওয়ারের সম্মিলনের মাধ্যমেই সুপার পাওয়ার হওয়া সম্ভব। এ তিনটির সমন্বয়ে এরদোয়ান তুরস্ককে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দেশটি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র। সেনা সংখ্যায় ন্যাটো জোচে দেশটির অবস্থান দ্বিতীয়। আর বিশ্বের শক্তিশালী মিলিটারীর দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান দশম স্থানে। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সেনা সংখ্যায় তুরস্কের অবস্থান প্রথম স্থানে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ইঙ্গিতও অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন এরদোয়ান। অধিকন্তু, তুরস্কে আমেরিকার মোতায়েনকৃত ৪০% পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের হাতে। সুতরাং তুরস্কের হাতে পারমাণবিক বোমা নেই- একথা বলা যাবেনা। এমতাবস্থায়, তৃতীয়বারের মতো তুরস্কের প্রেসিডেন্টের পদে বসে তুরস্কের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে কোন পরাশক্তির বলয়ে না ঢুকে, দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তুরস্ককে দুর্দমনীয় সামরিক শক্তি হিসেবে কতটুকু সামনে এগিয়ে নিতে পারবেন এরদোয়ান- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

    মন্তব্য

    <img class=”alignnone size-full wp-image-29676″ src=”https://bdsangbadpratidin.com/wp-content/uploads/2024/05/IMG_20240503_224849-2.jpg” alt=”” width=”100%” height=”auto” />

    আরও পড়ুন

    You cannot copy content of this page