আনোয়ার হোসেন-কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী)প্রতিনিধি >>>একসময় খাঁটি ভোজ্যতেল উৎপাদনে একমাত্র অবলম্বন ছিল ঘানি।ঘানি টানার কাজে ব্যবহার করা হত শক্তিধর বলদ গরু।কিন্তু প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ও বলদ গরুর দাম বৃদ্ধিতে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘানি শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে।তবে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ফজলে মামুদ(৭৫)নামের এক বৃদ্ধ স্বল্প মূল্যের ঘোড়াকে বেছে নিয়ে জিইয়ে রেখেছেন বাপ-দাদার ঐতিহ্যের ঘানি পেশা।তিনি উপজেলার বাহাগিলী ইউপির উত্তর দুরাকুটি তাঁতি পাড়া গ্রামের বাসিন্দা।জানা যায়,যন্ত্রবিহীন যুগে অশ্বারোহী ঘোড়া ছিল যুদ্ধক্ষেত্রসহ পিঠে আহরণ,বাহনের মত কাজের জনগুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।কিন্তু কালের বির্বতনে যান্ত্রিক যুগে ঘোড়ার কদর ও চাহিদা না থাকায় বাজার মূল্যে কম।আর গরুর সমকক্ষে ঘোড়া দিয়ে নানাবিদ কাজে ব্যবহার করা যায়।এতে এ উপজেলায় হালচাষ,বাহন ও ঘানিতে কদর বেড়েছে ঘোড়ার।অন্যান্যদের মত ফজলে মামুদ গত কয়েক বছর ধরে গরুর পরিবর্তে ঘোড়া দিয়ে ঘানি টেনে ৫ সদস্যর সংসার চালান।সরেজমিনে রোববার সকালে তার বাড়িতে দেখা যায়,ঘানির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ভাঙ্গা খাঁটি সরিষা তেলের সুগন্ধে আশপাশ মৌ-মৌ করছে।কাতারের উপর বসে ভর দিচ্ছেন নিজে।এসময় ঘোড়ার ঘুরপাকে পাতিলে চুয়ে চুয়ে পড়ছে তেল।ফজলে মামুদ বলেন,বাপ-দাদার পর ৬০বছর ধরে ঘানিতে তেল মাড়াই ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি।আগে গরু দিয়ে সরিষা মাড়াই করা হত।কিন্তু শক্তিধর গরু না হলে ঘানি টানতে পারেনা।ঘানি টানার কাজে যে ধরনের গরুর দরকার,বর্তমান বাজারে তার দাম লাখ টাকার অধিক।তাই গরু কেনার সামর্থ্য না থাকায় কয়েক বছর আগে ৮ হাজার টাকায় ১টি ঘোড়া কিনি।দৈনন্দিন এ ঘোড়া দিয়ে ১২কেজি সরিষা মাড়াই করে ৪ কেজি তেল,৭কেজি খৈল পাওয়া যায়।বিভিন্ন হাট-বাজারে প্রতি কেজি তেল ৪৮০টাকা,খৈল ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ৫০০টাকার মত আয় হয়,তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চালাই।একটা সময় সবাই ঘানির সরিষার তেল ব্যবহার করতো।এখন এ তেলের বিকল্প সয়াবিন,পামওয়েল,কলের সরিষা তেল ব্যবহার করছে।এতে চাহিদা না থাকায় সবাই এ পেশা পরিবর্তন করেছেন।বর্তমান আমি ছাড়া এ পেশায় আর কেউ নেই।কিশোরগঞ্জ সদর ইউপির রুপালি কেশবা গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তি আব্দুল মান্নান বলেন,গ্রামীণ জীবনে সরিষার তেল খুবেই গুরুত্বপূর্ণ।রান্না-বান্নাতে সরিষার তেল ব্যবহার ছাড়াও এর হরেক রকম ব্যবহার রয়েছে।আচার তৈরি,সিদল,সুঁটকি ও আলু ভর্তায় খাঁটি সরিষা তেলের জুড়ি মেলা ভার।
এ ছাড়াও নবজাতক থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষের শরীর,চুল যত্নসহ সর্দি-কাশি বা ভেষজ ওষুধ তৈরিতে খাঁটি বাংলার সরিষা তেলের তুলনা নেই।কিন্তু যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় আধুনিক মেশিনের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে সনাতনি ঘানি শিল্প যে ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আর ক’দিন গেলে হন্যে হয়ে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।তাই ঘানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি,বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবেই জরুরি।ফজলে মামুদ স্বল্প মূল্যের ঘোড়া দিয়ে বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেশা ধরে রাখার পাশাপাশি জীবিকার পথ সুগম করেছেন।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান আলম বলেন,প্রযুক্তির যুগের মানুষ অধিক উৎপাদনশীল যন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে।এতে স্বল্প উৎপাদন যোগ্য ঘানি শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে।এর মাঝেও ফজলে মামুদ ঘোড়া দিয়ে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদন করে ভোক্তাদের মাঝে সরবরাহের পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে আছে।সত্যি এ বয়সে তার সংগ্রামের তারিফ করতে হয়।
মন্তব্য