
একটা সময় কাঁচা বসতবাড়ি সিঁধকেটে কিংবা শিং দিয়ে চুরি করত শিং বা সিঁধেল চোর।সমাজে নানাভাবে চুরির ঘটনা ঘটলেও এ ধরনের লোমহর্ষক চুরির গল্পকাহিনী ছিল একেবারেই রোমাঞ্চকর। যা ছিল সুক্ষ চুরিবিদ্যা ও কঠিন কাজ।শরীরে তেল মেখে চুরির একটা ব্যাপার ছিল।যা দারুণ বুদ্ধিমত্তা ও সাহস দুটোই লাগত এ চুরিতে।রীতিমত এটি ছিল একটি শিল্পকর্ম।কালেরবির্বতনে সমাজ আজ অনেকটাই নিরাপদ ও উন্নয়নমূখী।গ্রামে নেই তেমনাটা কাঁচাবসতবাড়ি।এতে কোথায় হারিয়ে গেল গ্রাম-বাংলার সেই সূণিপুন হাতের শিং চোর ও তার শিল্পকর্ম।এক সময় উত্তর জনপদের জেলা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে মঙ্গা ভয়াবহ ছিল।অভাব ও স্বভাবের কারণে শিং চোরের কি যে উপদ্রব ছিল তা বলাই বাহুল্য।এ ধরনের চোর আঞ্চলিক ভাবে শিং চোর নামে পরিচিত ছিল।এমন চোরের যন্ত্রনায় পুরো এলাকা অতিষ্ঠ থাকত।কখন না সংসারের সর্বস্ব খুঁইয়ে যায়।রাত পোহালে কারোনা কারো বাড়ি চুরির হইচই পড়ত।পরনের পোষাক ছাড়া ঘরে থাকা রেড়িও,ক্যাসেট,টিভি,ভিসিয়ার,বাইসাকেল,স্বণার্লংঙ্কো,টাকা পয়সাসহ হাতের কাছে যা পেত সব কিছু ধুয়ে মুছে নিয়ে যেত।যে কোন ছদ্ম বেশে তারা এলাকার ধনবান গৃহস্তের কাঁচাবসতবাড়ির আদ্যপান্ত তালাশ করত।চুরির ব্যাপারে থাকত তাদের সন্ধান দাতা।একটু রাত হলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে গৃহস্তের বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়ে অবস্থান নিত নিশি কুটুমরা।এসময় বাড়ির লোকজন কখন ঘুমায়,কোন ঘরে কি মালসামানা আছে অনুসন্ধান চালায়।যতক্ষণ না বাড়ির লোকজন না ঘুমায় শীত কিংবা ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা।ততক্ষণ হাঁচি-কাশি দমন করতে হয়।সহ্য করতে হয় অসনীয় মশার কামড়।এমন চুরির বিবরণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবীণ দক্ষ শিং চোর বা ওস্তাদ বলেন,প্রথমে ঘরের কোনায় গিয়ে কান পাততে হয়।নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে বুঝে নিতে হয় ঘরের বাসিন্দাদের গতিবিধি।যদি হালকা জেগে থাকে মন্ত্র পড়ে নিন্দালি ঝাপানো হয়।এ অবস্থায় গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে পড়ে।এরপর সাবধানি হাতের নরম ছোঁয়ায় দেহের মাপজোক অনুযায়ী খুন্তি,পাসুন দিয়ে ঘরের ওলতিয়া,ডোয়া সুরঙ্গ করে ভিতরে প্রবেশ করা হয়।এর পর খুলে দেয়া হয় ঘরের দরজার হুরকা,ছিটকিনি।এসময় অন্ধকার ঘরের মালের হদিস করে একে একে পাচার করা হয়।নিরাপদে চুরির করাসহ আত্নরক্ষার জন্য অন্য ঘরের বাসিন্দাদের দরজা সামনে বেঁধে রাখা হত।তবে শিং কেটে অন্ধকার শয়ন কক্ষে চুরি করা অত্যান্ত কঠিন ও সাহসি কাজ।গুরুর পিছনে ঘুরে এ বিদ্যার্জন করতে হত।একটা সময় অভাবের তাড়নায় চুরি করে সংসার চালানো হত।চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়তে হয়েছে।বিচার শালিসে উত্তম মধ্যম খেতে হয়েছে।তারপরও চুরির নেশা ছাড়া কষ্টকর ছিল।তারপরও লোক লজ্জা,স্থানীয় ও প্রশাসনিক চাপে ৩০ বছর আগে চুরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় রিকসা চালিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে।বিগত কয়েক দশক থেকে এলাকার আত্নসামাজিক পরিবর্তন আসায় মঙ্গা বিড়ারিত হয়েছে।মানুষ এখন নানামূখী কর্মকান্ডে স্বচ্ছলভাবে জীবিকা নিবার্হ করছে।এতে সমাজে জাতকুলমানহারা পেশার লোক আর নেই।এক মসয় শিং দিয়ে বাড়ি চুরি যাওয়া পুটিমারী ইউপির শীলপাড়া গ্রামের কৃষক ভরত চন্দ্র শীল বলেন,রাত পোহালেই শারদীয় দুর্গোৎসব।এজন্য পিঠা পায়েস,চিরা তৈরির জন্য সিলভরের হাড়িপাতিলে ধান ভিজিয়ে রাখা হয়।ওই রাতে শিং দিয়ে বাইসাইকেল,রেড়িও,নতুন কাপড়,টাকা-পয়সা,পাতিলসহ ভিজানো ধান চুরি করে নিয়ে যায় শিং চোর।এতে ম্লান হয়ে যায় পুরো পরিবারের দুর্গোৎসব।এ ধরণের চোর শুধু বাড়ি চুরি নয়,খেটে খাওয়া মানুষের একমাত্র অবলম্বন হালগরুসহ গোয়াল শূন্য করে নিয়ে যেত।সময়ের বির্বতনে সমাজ এখন নিরাপদ ও শান্তিময়।বিছিন্নভাবে অন্য কোন চুরির ঘটনা ঘটলেও শিং দিয়ে বাড়ি চুরির ছিঁটেফোটাও শোনা যায়না।কোথায় হারিয়ে গেল গ্রাম-বাংলার সেই শিং চোর।