
আনোয়ার হোসেন,কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী)প্রতিনিধি >>> গ্রামবাংলার লোকশিকরের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী খেলা ধুলার হৃত গৌরব ফেরাতে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে যেন উৎসবের রং লেগেছে। এ উৎসবের রংয়ে রঙিন হয়ে উঠেছে পুরো গ্রামীণ জনপদ। বলা হচ্ছে এ জনপদের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা বাহাগিলী ইউনিয়নের নয়ানখাল চেয়ারম্যানের হাটে প্রতিনিয়ত বসা আবহমান বাংলার গ্রামীণ মানুষের নির্মল আনন্দ বিনোদনের হৃদয় ছোঁয়া পাতা খেলার আসরের কথা।গেল কয়েক দিন আগে ১ ম ও ২ য় রাউন্ডের খেলা শেষে বুধবার(২৫ জুন) চুড়ান্ত পর্বের খেলা ওই হাট সংলগ্ন একটি খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।ওই গ্রামের যুবসমাজের আয়োজনে ও বাহাগিলী ইউনিয়ন শাখা বিএনপির সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল্লাহ্ আল মামুন,সাধারণ সম্পাদক একেএম তাজুল ইসলাম ডালিমসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ প্রমুখ। খেলাটিতে স্থানীয়সহ বিভিন্ন প্রান্তর থেকে আসা ২ ধরণের তান্ত্রিক (ওঝা-কবিরাজের)দল অংশ গ্রহন করেন।অপর দিকে বহুকাল পর ওই খেলার কথা চাউর হলে এ উৎসবের রংয়ে মেতে উঠেন স্থানীয়সহ দূরদূরান্তর থেকে আসা নানা বয়সী মানুষ। এছাড়াও হালুয়া হাল ছেড়ে,জালুয়া জাল ছেড়ে,ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে, কিষাণ-কিষাণি কোদাল-পাসুন ছেড়ে ভোঁ দৌড় দেয় খেলার মাঠে।এ সময় দেখা গেছে,মাঠের চারপাশে নানা বয়সি হাজার হাজার দর্শক। দর্শকের কড়তালির মধ্যে দিয়ে শুরু হয় খেলাটি। এতে উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে অংশগ্রহণকারীরা শুরু করেন তন্ত্র-মন্ত্রের পাতা খেলা। মাঠের মধ্যখানে একটি কলা গাছ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে।এ কলা গাছের আশপাশ অবস্থান করেন প্রধান তান্ত্রিকের দল। তারা মন্ত্রবানের উপকরণ হিসেবে কলা গাছের গোড়ায় পানি ভর্তি মাটির ঘটিতে রাখেন কড়িয়া ফুল।পাশাপাশি বাঁশের কুলায় রাখেন সিঁদুর মাখা কলা,জবা,কড়িয়া ফুলসহ আগর বাতি ও ধুপকাটি। অপর দিকে মাঠের দর্শক সারিতে অবস্থান নেয় পাতা টানা ৪টি তান্ত্রিক দল। খেলা শুরুর আগে মন্ত্রবানে পরীক্ষা করে নেওয়া হয় ২জন আসল পাতা। এর পর শুরু হয় তান্ত্রিক দলের মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে পাতা টানার মরণপণচেষ্টা। ঢাক-ঢোলের শিহরণ তোলা বাজনা ও সানাইয়ের বিহুগল সুরের তালে তালে তান্ত্রিকদের পাতা টানার ছন্দের দোলা আর নানা তন্ত্র-মন্ত্রের ফুলঝুড়ি,শারীরিক অঙ্গভঙ্গির বর্ণিল কসরত।এসময় মন্ত্রবানে ভর হয়ে একজন পাতা হাত চাপড়ে শব্দ করছে। চিটপটাং হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।অন্য হনুমান পাতা গলাগাছের মগডালে উঠে বসে। দুই চোখে দেখাদেখি,চার চোখে টানাটানি,সপ্ত চোখে বস,ওরে বম। আমাকে ছাড়িয়া যদি অন্য দিকে যাস,দোহাই তোর-মহাদেব,দোহাই তোর- ঈশ্বরের মাথা খাস।’এমন সব মন্ত্র পড়ে পাতাদের পরাস্ত করার চেষ্টা চলে। এরই মধ্যে জমে ওঠে পাতা খেলা। দর্শকদের মুখে মুখে হাসি। হাতে হাতে করতালি। টান টান উত্তেজনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায়। পরিশেষে উত্তরবঙ্গের খ্যাতিমান তথা উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের নতুন টেপার হাটের যুবক তান্ত্রিক (কবিরাজ) মোজাহারুল ইসলাম মিষ্টার তার অলৌকিক মন্ত্রবানে কলা গাছে আহরণকৃত দুর্ধর্ষ হনুমান পাতা আব্দুর রহমানকে চূড়ান্ত খেলাসহ পূর্বের খেলায় পরাস্ত করে চ্যাম্পিয়ান খেতাব অর্জন করেন। সোহেল রানা নামে আর এক পাতাকে পরাস্ত করে সৈয়দপর খাতামধুপুরের তান্ত্রিক কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের দল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এ তান্ত্রিক দলের বিশেষ আকর্ষণ ছিল নারী মন্ত্র পাঠক । প্রথম বিজয়ী হিসেবে আয়োজক কমিটি তাকে (মিষ্টারকে)পাঁচ হাজার টাকা উপহার প্রদান করেন। দর্শক আঁখি মনিসহ আরো অনেকে বলেন,আমাদের জীবদ্দশায় কখনোই পাতা খেলা দেখেনি। এটি একটি ব্যতিক্রম ও অদ্ভুত খেলা। যা দেখে বিমোহিত হয়েছি। গ্রামীণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়মিত এ রকম আয়োজন করা দরকার।অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে মিষ্টার তার অভিব্যক্তিতে বলেন,বিগত কয়েক বছর থেকে এই খেলা খেলছি। শুধু এখানেই নয়,জেলা-উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খেলে আসছি। প্রতি খেলায় বিজয়ী হয়েছি। সব জায়গায় আমার খেলা দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছে এবং ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছেন। আয়োজক কমিটির পৃষ্ঠপোষক ওবায়দুর রহমান বলেন, হাজার-হাজার দর্শকদের মাঝে তান্ত্রিকরা মনোমুগ্ধকর মন্ত্র সাধনার মাধ্যমে এমন খেলা সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। সেই সাথে মাঠের চারপাশে দর্শকদের মাঝে সাংস্কৃতিক উন্মাদনাও তৈরি হয়েছিল।