চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান >>> সাতকানিয়ায় নৃশংস কায়দায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপরও একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেই চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব হামলায় দূর্বৃত্তরা কারো রগ কেটে দিয়েছে, কারো হাত-পা ভেঙ্গে দিয়েছে। দূর্বৃত্তদের হামলায় আহত অনেকে সারাজিবনের জন্য পঙ্গু হয়ে দূর্বিসহ জিবন যাপন করছে। ঘটনায় অনেকে সারা জিবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরন করে নিয়েছে। এসব ঘটনায় আহতরা কোথাও কোন অভিযোগ বা থানায় মামলা করার সাহসও করতে পারছেননা বলে জানিয়েছে। শুধু হামলা নয়, পাশাপাশি দূর্বৃত্তরা সমানে চাঁদাবাজিও করছে বলে অভিযোগ আছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর পরই মাইনুদ্দিন ওরফে বোমা মাইনুর নেতৃত্বে অন্তত ২৫ জনের একটি ‘কিশোর গ্যাং’ সোনাকানিয়া ইউনিয়ন ছাড়াও আশেপাশের এলাকায় তারা রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বাড়িতে বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট সবই হচ্ছে এই ‘কিশোর গ্যাং’য়ের নেতৃত্বে।
রিক্সাচালক জামালকে আহত করে তার দুই পায়ে ছুরিকাঘাত করে ঘাতকরা তার কয়েকটি আঙ্গুলও ভেঙে দেয় বলে জানায় সে। ১৯ আগস্ট রাত নয়টার দিকে ছোটহাতিয়া কালামিয়ার পাড়ার আহমেদ হোসেনের ছেলে রিকশাচালক জামাল উদ্দিন সোনাকানিয়ার বাংলাবাজার হয়ে ঘরে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে অন্তত ২০ জন কিশোর-তরুণের একটি দল মুহূর্তেই তার গতিরোধ করে মুখ বেঁধে প্রকাশ্যে তাকে পেটাতে পেটাতে স্থানীয় মাঝেরপাড়া পুকুরপাড়ে নিয়ে যায় বলে জানায় জামাল। পুকুর পাড়ে নিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপর চেপে বসে কাঠের বাটাম, লোহার রড দিয়ে বেদম প্রহার করে তার হাত পা ভেঙ্গে দিয়েছে, পরে তার দুই পায়ে চুরিকাঘাত করে দুই পায়ের রগ কেটে দিয়ে মারাত্বকভাবে জখম করে বলে জানায় সে। এসময় তাকে শিখয়ে দেওয়া কথা বলে ভিডিও করে বলেও জানায় সে। ভিডিও রেকর্ডে কথা না বলায় বাপ্পী নামে একজন ক্ষুর বের করে তার গলা কাটার জন্য উদ্যত হয় বলে জানায় জামাল। বেশ কয়েক ঘন্টা তার উপর অমানুষিক নির্যাতন রাত ১১ টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয় বলে জানায় সে। জামালের স্বজনরা পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তার জখম গুরুতর দেখে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দুর্বৃত্তদের সবার হাতে ছিল কাঠের বাটাম, লোহার রড, ছুরি। নির্যাতনের পুরো এই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন মাইনুদ্দিন ওরফে বোমা মাইনু ও রূপকানিয়া এলাকার মানিক।
একই কায়দায় দূর্বৃত্তরা ১৬ আগস্ট রাত ৯ টায় সোনাকানিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম স্থানীয় বাংলাবাজার থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে মির্জাখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে তার গতিরোধ করে ধরে হামলা ও নির্যাতন করে তার হাত পায়ের হাঁড় ভেঙ্গে দেয় এবং পায়ের রগ কেটে দেয় বলে জানায় সাইফুল ও তার স্বজনরা। সাইফুলের স্বজনরা পরে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিক ঘুরে পরে তাকে চট্টগ্রাম নগরীর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে একাধিকবার তার অস্ত্রোপচার করার পরও তার শারীরিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানান তার স্বজনরা। বিশেষ করে হাঁটুর জয়েন্টসহ একাধিক স্থানের আঘাত অত্যন্ত গুরুতর হওয়ায় তার পঙ্গুত্ব বরণের সম্ভাবনাই বেশি বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। শয্যাশায়ী সাইফুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন, আমার হাঁটু দুই পার্ট হয়ে গেছে। লাঠি দিয়ে তারা হাঁটুর নিচে প্রচণ্ড জোরে আঘাতের সাথে সাথেই সে আমি বেহুঁশ হয়ে যায় বলে জানায়।এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানান, দুর্বৃত্তদের হাতে লোহার রড, ধারালো কিরিচ, রিক্সার চেইনসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ছিল।সাইফুল আরো বলেন, আমি তো কখনও অন্যায় কিছু করিনি। তাহলে আমাকে কেন পঙ্গু করা হল? আমি তো দেশবিরোধী কিছু করিনি, কারও মনে কখনও কষ্ট দিইনি, তাহলে আমার ওপর এভাবে কেন হামলা করা হল?’ হামলাকারীদের দলে ১৫-২০ জন সবাই মুখে মাস্ক পরা থাকায় সাইফুল কাউকে চিনতে পারেনি বলে জানায়।আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর বিভিন্ন হুমকির মুখে আগস্টের মাঝামাঝিতে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান সোনাকানিয়া ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় কৃষক আবদুচ ছমদ। হতদরিদ্র ছমদ বাড়িতে গরু-মুরগি পালন করে কোনোমতে সংসার চালান। সংসারের অবলম্বন গৃহপালিত গরুর জরুরি চিকিৎসা করাতে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি অনেকটা লুকিয়ে বাড়িতে আসেন। কিন্তু কোনোভাবে এ খবর পেয়ে অন্তত ২০ জনের একদল দুর্বৃত্ত ধারালো অস্ত্র নিয়ে আবদুচ ছমদের বাড়িতে হানা দেয় কিছুক্ষণের মধ্যে। তাকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে তার দুই পায়ের হাড়ও ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। প্রচণ্ড মারধরে তার বাম হাতও দুই ভাগ হয়ে যায় জানায় স্বজনরা। পঙ্গু অবস্থায় আবদুচ ছমদ বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এভাবে একই কায়দায় মসজিদ থেকে বের করে কলেজশিক্ষক আবদুস সবুরকে নির্যাতন করা হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে। ৩০ আগস্ট সাতকানিয়া মহিলা কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর সোনাকানিয়ার মির্জাখীল ২ নম্বর ওয়ার্ডে তার নিজ বাড়ির মসজিদে আসরের নামাজ পড়ছিলেন। একদল দুর্বৃত্ত মসজিদে ঢুকেই শিক্ষক সবুরকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন। এ সময় তাদের হাতে চাইনিজ কুড়াল, চাপাতি, লোহার রড, হকিস্টিক ও রিক্সার চেইন দিয়েই সবুরকে এলোপাতাড়ি মারধরে শিক্ষক সবুর দুই হাত ও কাঁধে গুরুতর আঘাত পান। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তার স্বজনরা তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান অজ্ঞাত স্থানে। পরদিন তিনি সাতকানিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এতে নেজামউদ্দিন, ইয়াহিয়া, আরিফ, মইনুদ্দিনসহ ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
৫ আগস্ট রাত একটার দিকে অন্তত ২০ জনের একদল দুর্বৃত্ত সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাতিয়ারকুল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসাইন চৌধুরীর বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা পুরো বাড়ি ভাঙচুর ও তছনছ করে। তার ছেলে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ স্বাস্থ্য সম্পাদক এডভোকেট শাহরিয়ার। হামলার একপর্যায়ে তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয় বলে জানা যায়, এ ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসাইন সাতকানিয়া থানায় একটি অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
এর ঠিক পরের দিন দিবাগত ভোররাতে সোনাকানিয়া ইউনিয়ন ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সালের, ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রলীগ নেতা মিরাজ, এসআর শামীমের বাড়ির গেইট ভেঙে বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
৭ আগস্ট দিবাগত ভোর রাতে সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মেইন গেইট ও দেয়াল ভেঙে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জনের একদল দুর্বৃত্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এসআর শামীমের ঘরে ঢোকে। তারা বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ভাঙচুর চালায়। বাড়িতে থাকা সাড়ে চার ভরি স্বর্ণ, নগদ ৬০ হাজার টাকাসহ বাড়িতে থাকা বিভিন্ন দামি জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। ব্যাপক ভাঙচুরে অন্তত ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এমন কথা জানিয়ে এসআর শামীম বলেন, ‘আমরা তো কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় নই। এরপরও কেন আমার বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হল, তা আমি বুঝতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার পরদিন আমরা সেনাবাহিনীর কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছিলাম।’
একই রাত পৌনে একটার দিকে একদল দুর্বৃত্ত সোনাকানিয়ার গারাঙ্গিয়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নূর আহমদের বাড়িতে হানা দেয়। এ সময় তারা পরিবারটির গরুর খামারে আগুন লাগিয়ে দেয়। রাতভর তারা একযোগে অন্তত ৫০০টি ছোট-বড় গাছ কেটে ফেলে। যাওয়ার সময় চারটি গরুসহ একটি মোটরসাইকেল লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় তারা ওই পরিবারের মালিকানাধীন কয়েকটি দোকানও ভাঙচুর করে। ডাকাত সেলিমের নেতৃত্বে এই হামলার ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ সময় নূর আহমেদের ছেলে মোস্তাফিজকেও মারধর করা হয়। এ ঘটনায় পাঁচজনকে আসামি করে সাতকানিয়া থানায় একটি মামলা হলেও দুর্বৃত্তচক্র আগের মতোই বেপরোয়া।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বেলা ১২টার দিকে গারাঙ্গিয়ায় মোস্তাফিজের ভাই সাইফুল ইসলামকে তার দোকানে গিয়ে ওই একই চক্র মারধর করে। পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে দুর্বৃত্তদের দলটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে এসে আগে থেকে কাটা গাছগুলো জোর করে নিয়ে যায়। ৫০টি সেগুন গাছসহ অন্তত ৫০০ গাছ তারা নিয়ে গেছে বলে জানান ঘটনার শিকার মোস্তাফিজ।
১৮ আগস্ট সোনাকানিয়ার জমাদারপাড়া এলাকায় ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফ উদ্দিন খোকাকে মারার জন্য তাড়া করে একদল দুর্বৃত্ত। খোকা এ সময় প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও দুর্বৃত্তরা তার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। যাওয়ার সময় তারা দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। নইলে খোকাকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেয়।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর পরই সোনাকানিয়ার মির্জাখীল গ্রামের মাইনুদ্দিন ওরফে বোমা মাইনুর নেতৃত্বে অন্তত ২৫ জনের একটি ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে ওঠে। সোনাকানিয়া ইউনিয়ন ছাড়াও আশেপাশের এলাকায় তারা রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে। স্থানীয়রা জানান, তাদের কথাই সেখানে রীতিমতো আইন। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বাড়িতে বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট সবই হচ্ছে এই ‘কিশোর গ্যাং’য়ের নেতৃত্বে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোমা মাইনুর সহযোগী হিসেবে এই কিশোরগ্যাংয়ে নেতৃত্বে আরও আছেন রূপকানিয়ার মানিক ওরফে ডাকাত মানিক, হাতিয়ার কুলের গিয়াসউদ্দিন, দক্ষিণ মাদার্শা ছড়ার কুলের এহতেশামুল হক বিজয়, সোনাকানিয়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পিচ্চি জাহেদ, সজীব, নাছির, সাইরতলীর আমিনুল ইসলাম ওরফে ডবল আমিন, সাতকানিয়া পৌরসভা ৬নং ওয়ার্ডের সম্রাট, ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ালসহ আরও কয়েকজন।
এলাকাবাসীদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই দুর্বৃত্তরা জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্রশিবিরের কোনো পদে না থাকলেও
একাধিক ছবি ও ভিডিওতে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে মাইনুদ্দিনসহ অন্যদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তফা কামালের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ৫ আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে গণ অভ্যূত্থানের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশতঃ বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে যেকোন ঘটনার ব্যাপারে থানায় অভিযোগ আসলে সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য